ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

গুমের ৭৬ দিন
প্রকাশ: রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:৪২ এএম আপডেট: ২৯.০৯.২০২৪ ৭:৪৯ এএম  (ভিজিট : ২৮৩)
‘বাথরুমে যাওয়ার সময় চোখ বেঁধে নিয়ে যেত। বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে দিত না। সিভিলে দুজন পাহারায় থাকত। এক দিন রাতে তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বলে আমি নাকি বোমা হামলা চালিয়েছি। আমি তাদের বলি আমাকে কেন নিয়ে এসেছেন? আমি এসবের সঙ্গে জড়িত না। তারা বলে, যেটি বলব সেটি করবি, না করলে মেরে ফেলব।’ এভাবেই স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিজের ওপর ভয়ংকর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন ১৬ বছর বয়সে গুমের শিকার হওয়া কিশোর আবু সাদেক। সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনও শিউরে ওঠেন তিনি। সম্প্রতি সময়ের আলোর ৭৬ দিন গুম থাকা এবং মিথ্যা মামলায় ১৮ মাস কারাভোগের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। চেয়েছেন তার ওপর ঘটে যাওয়ার অন্যায়ের ন্যায়বিচার।

সময়ের আলোকে আবু সাদেক বলেন, ‘২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকায় আমার ফুফাতো ভাইয়ের দোকানে চাকরি করতে যাই। ওই বছরের ২৬ জুলাই দোকান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়িতে যারা ছিল সবার কাছে অস্ত্র ছিল।’

এবার বান্দরবান সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। তিনি বলেন, ‘আমাকে একটি কালো মাইক্রোবাসে তুলে রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। আমাকে নিয়ে গাড়িটি চলতে থাকে। গাড়ি চলতে চলতে তারা আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করে। প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দেওয়ার পর তারা গাড়ি থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটায়। এরপর আমাকে একটি রুমে নিয়ে চোখ খুলে দেয়। রুমে এসি, চেয়ার, বেড ও জানালাবিহীন একটি লকআপ ছিল।’

সাদেক বলেন, ‘দেয়ালে লেখা ছিল গুম হওয়া ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার। বাথরুমে যাওয়ার সময় চোখ বেঁধে নিয়ে যেত। বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে দিত না। সিভিলে দুজন পাহারায় থাকত। এক দিন রাতে তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বলে আমি নাকি বোমা হামলা চালিয়েছি। আমি তাদের বলি আমাকে কেন নিয়ে এসেছেন? আমি এসবের সঙ্গে জড়িত না। তারা বলে, যেটি বলব সেটি করবি, না করলে মেরে ফেলব। এটি হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। এটি পরে জানতে পারি একজন পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে।’

সাদেক আরও বলেন, ‘পরদিন আমাকে একদম সকালে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ হতে বলে। আমি ফ্রেশ হয়ে নাশতা করি। নাশতা দেয় একটি মাম পানি, পাউরুটি ও কলা। এরপর আমাকে চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে নিয়ে যায়। প্রায় তিন ঘণ্টা গাড়িতে অবস্থান করি। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে যমুনা সেতু দেখবে কি না! আমি চুপ থাকি। তারা চোখ খুলে দিলে দেখি যমুনা সেতু। তখন মনে করি, আমি এতক্ষণ ঢাকায় ছিলাম এখন উত্তরবঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর আরও এক থেকে দুই ঘণ্টা গাড়ি চলে। তারা চোখ বাঁধার সময় একটু হালকা করে বেঁধেছিল তখন আমি একটু একটু দেখতে পাই। পরে দেখি বগুড়া থানার সাইনবোর্ড। তখন আমি নিশ্চিত হই যে বগুড়া থানায় অবস্থান করতেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাকে একটি ভবনে নিয়ে যায়। ভবনের ওপরে লেখা ছিল ‘ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার’। একটি রুমে আমাকে বসিয়ে রাখে কিছুক্ষণ। পরে চোখ খুলে দেয়। তখন দেখি ছোট ছোট ‘আয়নাঘর’। একটি আয়নাঘরে আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে ছিল একটি লোহার সিট। সিটের সঙ্গে বাঁধা দুটি হ্যান্ডকাপ। একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া লাগানো। একটি সিটের সঙ্গে আরেকটি আমার হাতে বাঁধে। নামাজ পড়ার সময়ও হ্যান্ডকাপ খুলে দিত না। একহাত বুকে দিয়ে নামাজ আদায় করা লাগত, অন্য হাত হ্যান্ডকাপের সঙ্গে ঝুলে থাকত। এমনকি ঘুমানোর সময়ও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রাখত।’

এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘সেখানে আমাকে টানা তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ করে একজন অফিসার এসে। সে প্রমাণ করতে চায়, আমি একটি হামলায় ছিলাম। আমার বিস্তারিত অ্যাড্রেস নেয়। অফিসাররা সিভিলে থাকত। আর বাকিরা বাহিনীর পোশাকে। কিন্তু নামের ব্যাজটা খুলে রাখত। তাদের রেঞ্জ লেখা ছিল রাজশাহী। পরে আমাকে ওখানে ২ মাস ১৬ দিন আটকে রাখা হয়। তারা আমাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করত।’

আবু সাদেক বলেন, ‘২০২০ সালের ১২ অক্টোবর মাগরিবের পর একটা লোক এসে বলে রেডি হও। আমি রেডি হওয়ার পর সন্ধ্যা ৭টায় আমাকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে ওই ভবন থেকে বের করে একটি গাড়িতে তোলে। প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পর গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার অন্য গাড়িতে তোলে। পরে ওই গাড়িতে আমার নাম জিজ্ঞেস করে। গাড়ি আরও ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা চলে। এরপর আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি ভবনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে তোলে। চোখ খুলে দেখি সকাল হয়েছে। পরে নাশতা দেয়। পরদিন ১৩ অক্টোবর সকাল ১০টার পর একজন অফিসার এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা আমার বয়স নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। যদিও তখন আমার বয়স ছিল ১৬। তখন আমাকে বয়স ১৯ বলতে বলে।’

তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর ২ নং গেট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তখন আমার এসএসসি পরীক্ষা ছিল। আমিই ওইদিন বোমা হামলা করেছি-এটি স্বীকার করতে বলে পুলিশ। আর গুম থাকার বিষয়টি কখনো কাউকে বলতে নিষেধ করে। বললে মেরে ফেলবে। এটা ছিল চট্টগ্রামের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি সাইনবোর্ডের সামনে নিয়ে গিয়ে পেছনে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে আমিসহ মোট ছয়জনের ছবি তোলে। পরে চট্টগ্রাম আদালতে নিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে নিয়ে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কেন নিয়ে এসেছে। আমি সব সত্য কথা বলি এবং জানাই আমার বয়স ১৬। আমি হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, এটিও বলি। পরে ম্যাজিস্ট্রেট ১৬৪ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড করেননি। পরে মামলাটি শিশু আইনে নিয়ে যান। পুলিশ আমার এক দিনের রিমান্ড চাইলেও আদালত তা নামঞ্জুর করে আমাকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠায়।’

আবু সাদেক বলেন, ‘২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর আমাকে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। প্রায় ৯ মাস ধরে জামিন হচ্ছিল না। পরে এক দিন হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছি বলে জানতে পারি। কিন্তু জামিনের কাগজ আসতে দেরি হচ্ছিল। পরে কারাগারে থাকাকালে শুনি আমার নামে গাজীপুরের বাসন থানায় আরও একটি মামলা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই গাজীপুর আদালতে নিয়ে যায়। এরপর আমার দুদিনের রিমান্ড চাইলে আদালত নামঞ্জুর করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলে। পরদিন অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসে। নাম এবং কেন জেলে গেছি এসব জিজ্ঞেস করে। আরও অনেকের নাম বলে জানতে চায়Ñতাদের চিনি কি না, এরপর তারা চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আরও ৯ মাস ২৪ দিন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকি। অবশেষে ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল জামিন পাই হাইকোর্ট থেকে। দীর্ঘ ১৮ মাস ৪ দিন কারাবরণ করি। গুমসহ ২০ মাস ২০ দিন। আমি নির্দোষ! আমার জীবন থেকে ২০ মাস ২০ দিন চলে গেল। আর দুটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা। মামলার এজাহারেও নাম ছিল না। একটি চট্টগ্রাম আর একটি গাজীপুরের। আমার পক্ষে মামলাগুলো চালানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।’

আবু সাদেক প্রশ্ন করে বলেন, আমি যদি অন্যায় করে থাকি, আমাকে গুম করল কেন? ১৬ বছর বয়সকে ১৯ বছর করল কেন? জেলে থাকাকালীন আরও একটি মামলা দিল কেন? নতুন বাংলাদেশে কি এটির বিচার হবে?

তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী মামলা প্রত্যাহারসহ হয়রানির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন বান্দরবান সরকারি কলেজের এ শিক্ষার্থী।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close