ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

শিক্ষার্থী-জনতা অভ্যুত্থানের অহিংস চরিত্র
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:৫১ এএম  (ভিজিট : ৭৯৪)
জুলাই মাসের মধ্যভাগে কোটা সংস্কারের আন্দোলন যে পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল, তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। বিগত দেড় দশকের আওয়ামী রেজিমকে ফ্যাসিবাদী, উর্দিবিহীন স্বৈরতন্ত্র, নিখোঁজ গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী ইত্যাদি নানা বর্গে চিহ্নিত করলেও এর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রায় সব বর্গেই হাজির ছিল। টানা তিন মেয়াদে কারচুপির নির্বাচন, পদ্ধতিগত গুম, খুন, ক্রসফায়ার (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড), মতপ্রকাশের অধিকার হরণ ও অর্থ পাচার ছিল গণতন্ত্রহীন হালতে উপনীত হওয়ার নির্ধারক। ফলে চাকরিজনিত ইস্যুর উছিলায় মূল আন্দোলন মাঠে গড়ালেও সরকারি দমনপীড়ন এবং গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অধীনে বসবাসের যন্ত্রণা পুরো জনগোষ্ঠীকে বিদ্যমান রাষ্ট্র ও ক্ষমতা কাঠামোতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত করে।

যদিও মনে হতে পারে, এটি দ্রুততর সময়ে ঘটেছে, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, যে রেজিম যত দীর্ঘমেয়াদি, তার পতনও তত দ্রুত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস যেমন আমাদের কাছে আচানক নয়, তেমনি রাজনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে শিক্ষার্থীদের তৎপরতাও আচানক ছিল না। আইয়ুব খানের আমলে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন তৎকালীন রাজনৈতিক স্থবিরতাকে কাটিয়ে দিয়েছিল; এরশাদের আমলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোকে দিশা দিয়েছিল। তবে আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াতে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার হিসাব আমলে নিয়ে বলা যায়, কেবল মুক্তিযুদ্ধকালের যুদ্ধাবস্থা ব্যতীত আর কোনো আন্দোলনে এত রক্ত ঝরেনি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ৬১ জনের মতো লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন। এবার আন্দোলনের মূল ২০ দিনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হামলায় প্রায় ৮০০ জনের বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছেন। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

যে আইয়ুব শাসনামলকে পুরো জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চা চরম নেতিবাচক ও ন্যক্কারজনক হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে, সেই আইয়ুবের পুলিশ-সেনাবাহিনী চূড়ান্ত অবস্থাতেও এত লোককে গুলি করে হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশে হরদম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম-জপনেওয়ালা দল নির্বিচারে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সরাসরি উত্তরাধিকার। ওই দুই আন্দোলনের ধরন, অন্তত কেতাবি ভাষায় বলতে হয়, অহিংস ছিল। এমনকি বিগত দশ বছর ধরে বিএনপি যত আন্দোলন করেছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় নানাবিধ উসকানি থাকা সত্ত্বেও সহিংসতা থেকে নিজেদের দূরে রাখার যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা, তাতে কৌশল হিসেবে অহিংস নাগরিক অনানুগত্য বা সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্সকেই কৌশল হিসেবে গ্রহণের নজির ধরা পড়ে। এখন জুলাই মাসেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন মাঠে গড়ায়, তখনও সেটির পন্থা যেমন-রোডব্লক, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি মোটাদাগে অহিংসের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু একটা সময় পর যখন প্রধানত রাষ্ট্রীয় সহিংসতা প্রতিরোধে আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও হাজির হলো, তাতে একটা প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে: আন্দোলনের ধরন কেমন ছিল? অহিংস নাকি সহিংস? আর এই সহিংস বা অহিংস আন্দোলন বলতে আদতে দুনিয়াতে কী বোঝানো হয়ে থাকে?

দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতাকে (ভায়োলেন্স) অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের সর্বাধিক জরুরি অনুষঙ্গ বলেই বিবেচনা করা হয়েছে। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনগুলো কেন অনিবার্যভাবে সহিংসতায় রূপ নেয় বা শ্রেণি সংগ্রাম কেন সহিংস হয়ে উঠতে বাধ্য হয় তা নিয়ে প্রচুর তত্ত্বকথা তৈরি হয়ে আছে। খোলা চোখে দেখলে ধ্রুপদী যে বিপ্লবগুলোর কথা আমরা স্মরণ করি বা কল্পনা করি, তার সবই ছিল সশস্ত্র লড়াই। আন্দোলন/বিপ্লব/অভ্যুত্থান হবে এবং সহিংস কায়দা ছাড়া সাফল্য আদায় করা সম্ভব হবে না এমনতর ভাবনার প্রাধান্য ছিল প্রায় সবখানেই। আমাদের মতো দেশে, যেখানে দীর্ঘদিনের সশস্ত্র বামপন্থি রাজনীতির ঐতিহ্য রয়েছে, সেখানে তো এই ভাবনার বাইরে আসলে খুব একটা আলোচনাই নেই, যদিওবা আমাদের ইতিহাসের চর্চিত অধিকাংশ আন্দোলনের ধরন ছিল ‘অহিংস’।

ইতিহাসে অহিংস আন্দোলনের নজির দীর্ঘ হলেও বিদ্যায়তনিক জগতে এই নিয়ে আলোচনা শুরুর খুব বেশিদিন হয়নি। উনিশ শতকে হেনরি ডেভিড থরো বা বিশ শতকের হাওয়ার্ড জিন নৈতিক জায়গা থেকে সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স বা গণ-অনানুগত্যের কথা বলেছেন, অন্যদিকে জিন শার্প কৌশলের জায়গা থেকে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অহিংস আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। হালজমানার গবেষকরা খেয়াল করেছেন যে, পৃথিবীতে অহিংস প্রতিরোধ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরিখা চেনোওয়েথ ও স্টিফেন তাদের এক কাজে প্রায় একশ সহিংস ও অহিংস আন্দোলনের হিসাব কষে দেখালেন যে, ৫২ শতাংশ অহিংস আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেছে। 

অন্যদিকে সহিংস আন্দোলনের ক্ষেত্রে সে হার মাত্র ২৬ শতাংশ। এখানে সহিংস আন্দোলন বলতে বোঝানো হচ্ছে যেখানে আন্দোলনের নীতি ও কৌশল হিসেবে ভায়োলেন্সকে গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে অহিংস আন্দোলনের নীতি ও কৌশল হচ্ছে প্রাণহানি রোধ বা হ্রাস করা। ফলে এখানে সহিংসতাকে পরিহার করে নিরস্ত্র বিভিন্ন কায়দা-কানুন যেমন-সমাবেশ, হরতাল, ধর্মঘট, বয়কট, অসহযোগিতা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। যারা অহিংস আন্দোলনের পক্ষে ওকালতি করেন তারা এও দেখিয়েছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে অহিংস আন্দোলনের প্রভাব সহিংস আন্দোলনের চেয়ে বেশি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো আন্দোলনকে কি পুরোপুরি অহিংস বা সহিংস এই ডাইকোটোমিতে ভাগ করে ফেলা সম্ভব? অহিংস আন্দোলনের মধ্যে কি সহিংসতা থাকতে পারে না? যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে   দেখা গেল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, নেতৃত্বস্থানীয়দের বাসাবাড়ি ও পুলিশের থানাতে লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এগুলোকে কি সহিংস নাকি অহিংস হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? কেউ কেউ এটিকেও সহিংসতা বলেছেন। কেউ কেউ আবার এই নজিরগুলোকে ‘সহিংস’ বলতে নারাজ। কেননা আন্দোলনের কৌশল হিসেবে এসব মানুষের জানের ওপর হামলা করেনি বা একে মূল কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করেনি।
অহিংস ও সহিংস এই বর্গের শিথিলতার কারণে সাম্প্রতিক গবেষকরা একটু ভিন্নভাবে আন্দোলনগুলোকে বর্গায়িত করে : নিরস্ত্র প্রতিরোধ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ। এখানে ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ বলতে কী বোঝাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়; সহিংস আন্দোলনের সংজ্ঞাতে যা বলা হয়েছিল সেটিই ছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ। অন্যদিকে ‘নিরস্ত্র প্রতিরোধ’ এর মধ্যে পড়ে অহিংস প্রতিরোধ এবং নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতা (আন-আর্মড কালেক্টিভ ভায়োলেন্স)।

অহিংস প্রতিরোধ হচ্ছে সমাবেশ, হরতাল, বয়কট ইত্যাদি। সেখানে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোই মূল কথা। অন্যদিকে নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতা হচ্ছে নিরস্ত্র জনতার সামূহিক অ্যাকশন। সেখানে ভাঙচুর (ভ্যান্ডালিজম), সম্পত্তি ধ্বংস করা, রাস্তায় ইটপাটকেল ছোড়া, অগ্নিসংযোগ করা ইত্যাদি থাকবে; কিন্তু সামরিক অস্ত্র বলতে যা বোঝায়, তার ব্যবহার থাকবে না। জনগণ অনেকটা খালি হাতে যে লড়াই চালায়, সেটিকেই এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে। ফলে সহিংস ও অহিংস আন্দোলনের এই দুই বর্গকে প্রতিস্থাপন করা হয় নিরস্ত্র ও সশস্ত্র এই দুই বর্গ দিয়ে। অহিংস আন্দোলনকে নিরস্ত্র আন্দোলনের অংশবিশেষ হিসেবে যেমন চিহ্নিত করা হয়, তেমনি নিরস্ত্র প্রতিরোধকে কখনো কখনো অহিংস আন্দোলনের সমার্থক হিসেবেই তুলে ধরা হয়।

এই আলোচনাতে আরেকটা প্রশ্ন অবধারিতভাবে চলে আসে। তা হলো একেবারে অহিংস আন্দোলনে কখন সহিংস উপাদান যুক্ত হয়? অহিংস প্রতিরোধ কখন নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়? গবেষকরা মনে করেন, আন্দোলন অহিংস থেকে সহিংসতার দিকে যাত্রা করে প্রধানত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ইতিহাসে সহিংস আন্দোলন থেকে অহিংস আন্দোলনের রূপান্তরের নজির যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অহিংস আন্দোলনের সহিংস হয়ে ওঠার নজির। সেটি সশস্ত্র না হলেও আমরা ওপরে যা নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত করেছি সেদিকে ধাবিত হয়।
রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নির্মমতা যেমন করে অহিংস আন্দোলনকে সহিংস করে তোলে কিংবা সহিংস উপাদান যুক্ত করতে বাধ্য করে, তেমনি আন্দোলনে সমাজের কত বিচিত্র শ্রেণি ও রাজনৈতিক শ্রেণি যুক্ত হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে সেই মাত্রা। আন্দোলন যত স্বতঃস্ফূর্ত হয়, নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতার দিকে ধাবিত হওয়ার ঝুঁকিও তত বাড়ে। 

আগেই বলেছি, এই সহিংসতার মাত্রা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। লুটপাট বা সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতিকে কেউ কেউ সহিংস উপাদান বললেও অনেকেই এটিকে অহিংস বলেই রায় দেন। এরিখা মনে করেন, এটি আন্দোলনের কৌশলের ওপর নির্ভর করে।

অহিংস আন্দোলনের এমন সহিংস উপাদানের প্রভাব কেমন হতে পারে, এ নিয়েও দুটো মত রয়েছে। একপক্ষ মনে করেন, এটি দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে ক্ষতি করে কেননা সহিংস উপাদানের উপস্থিতি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে জায়েজ করে তুলতে পারে। আরেক পক্ষ মনে করে, এই ধরনের আন-আর্মড কালেক্টিভ ভায়োলেন্স দিনশেষে ফলদায়ক। ২০১১ সালের মিসরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ দেখিয়েছেন, এই ধরনের সহিংসতা যেমন পুলিশের থানা লুট বা অগ্নিসংযোগ আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। এক হিসাব মতে, ২০১১ সালে মিসরে আরব বসন্তকালে পুলিশের প্রায় ৪ হাজার যানবাহন এবং ২৫ শতাংশ থানাতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। কায়রোতেই প্রায় ৫০ শতাংশ থানা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছিল। তারা বলছেন এ ধরনের সহিংসতা দিনশেষে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন কমাতে সাহায্য করেছিল, ফলে এটি অহিংস আন্দোলনের বিপরীতে না গিয়ে তাকে আরও বেগবান করেছিল।

আরেক দল গবেষক দেখিয়েছেন, স্ট্রিট ফাইটিং বা সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির মতো লো-লেভেলের ভায়োলেন্স রাজনৈতিক মুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এমনকি এই ধরনের লড়াই বা সহিংসতা অ্যাক্টিভিস্ট বা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আবেগ সঞ্চার করে, এক ধরনের রাজনৈতিক এম্পাওয়ারমেন্টের অনুভূতি দেয়।

আন্দোলনের ইতিহাস ও এ ধরনের আলোচনার আলোকে বলতে পারি, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পুরোদমে অহিংস আন্দোলন ছিল। ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকার গালি দেওয়ার পর আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ওবায়দুল কাদের যখন ছাত্রলীগকে আন্দোলন দমানোর খোলা আহ্বান জানান, তখনই প্রথম আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। এরপর সেই হামলাতে যুক্ত হয় পুলিশ-বিজিবি। পুলিশের গুলিতে একদিকে যেমন রাজপথ রক্তাক্ত হচ্ছিল, তেমনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্র-জনতা প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিলেন। পুলিশি নিপীড়ন, ক্রসফায়ার, গুম, অবিচার, দুর্নীতি, লুট, পাচার, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ আওয়ামী জমানার নানাবিধ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল এই প্রতিরোধ। পুলিশের আক্রমণের তীব্রতার সমান্তরালে জনতার প্রতিরোধও শক্ত হচ্ছিল। সারা দেশের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ যেসব স্থান, নিদর্শন বা প্রতীক ব্যবহার করে দিনের পর দিন দুর্নীতিকে জায়েজ করেছে, গণতান্ত্রিক যাত্রাকে রুদ্ধ করে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে এস্তেমাল করেছে, সেগুলোর প্রতি জনতার আক্রোশ ছিল সবচেয়ে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় যেমন আগুন দেওয়া হয়েছে, তেমনি আন্দোলনের মুহূর্তে বিভিন্ন থানায় আগুন দেওয়া হয়েছে, রাজপথে খালি হাতে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করেছে সাধারণ জনগণ।

অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার মুখোমুখি হয়ে আন্দোলনে সহিংস উপাদান যুক্ত হয়েছে। একেই আমরা নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতা বলছি। রাজপথ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়া, পুলিশকে ধাওয়া দেওয়া, থানায় হামলা করা এবং আন্দোলনের শেষের দিকে ক্ষমতাসীনদের প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে লুট ও অগ্নিসংযোগ সবই এই ধারার সহিংসতা। আমাদের মিডিয়া কিংবা গণপরিসর এই পরিস্থিতিকে আচানক হিসেবে ঠাহর করলেও সাম্প্রতিক গণআন্দোলনের ইতিহাসে এমন বাস্তবতা মোটেও আচানক কিছু নয়। 

২০০৬-২০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে যত আন্দোলন হয়েছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রধান কারণ ছিল। পাশাপাশি আন্দোলনের পদ্ধতি পুরোদমে অহিংস হলেও প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাঙচুর ও লুটপাট দেখা যায়। ফলে কেবল বাংলাদেশেই নয়, এটি সারা দুনিয়ার গণআন্দোলনের ক্ষেত্রেই খুব সাধারণ উপাদান।

এই আন্দোলনকে যে কেতাবি ভাষায় অহিংস বা নন-ভায়োলেন্ট সিভিল রেসিস্ট্যান্স বলা চলে তা মোটামুটি আন্দোলনের গতিপথ ও যে ধরনের কর্মসূচি আহ্বান করা হয়েছিল তা থেকেও প্রমাণিত হয়। দুনিয়ার অন্যান্য স্থানে যেমন করে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও নিপীড়নের মুখোমুখি হয়ে আন্দোলন নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়েছে, এখানেও সেটি হয়েছে। কিন্তু আন্দোলন কৌশলগত জায়গা থেকে কখনোই কোনো ধরনের সহিংসতাকে গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশের গণআন্দোলনের ইতিহাসেও জ্বালাও-পোড়াও বা সহিংসতা মোটেও অচিন নয়। কিন্তু এবার যে নিরস্ত্র সামূহিক সহিংসতা দেখা গেছে, সেটি বাংলাদেশের সব গণআন্দোলনে দেখা গেলেও রাষ্ট্র যে ভাষায় সেটিকে হাজির করেছে, তাতে যেমন পূর্বের ঘটনাগুলোর সঙ্গে মিল রয়েছে, তেমনি যথেষ্ট নতুনত্ব রয়েছে। এই নতুনত্ব যেমন রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় রয়েছে, তেমনি রয়েছে সহিংসতা বিষয়ক রাষ্ট্রীয় বয়ানের মধ্যেও। সে আলাপ আরেক দিন।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close