ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সিস্টেম লস জায়েজ করতে মরিয়া জিটিসিএল
প্রকাশ: শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:৪৭ এএম  (ভিজিট : ২১৭৪)
সিস্টেম লস হওয়ার কোনো রকম সুযোগ নেই গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডে (জিটিসিএল)। তারপরও তাদের সিস্টেম লসের পরিমাণ আড়াই থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ। জিটিসিএল এতদিন সিস্টেম লস অন্য কোম্পানির কাঁধে চাপিয়ে বিপুল পরিমাণ লাভ করেছে। আর সেই লাভের পাহাড় থেকে প্রতি বছর দুই থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস পেয়ে এসেছে। গত বছর থেকে সিস্টেম লসের টাকা জিটিসিএলের ওপর ন্যস্ত হয়। এতে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর আঁতে ঘা লাগে। এতদিন কিছু না বললেও বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এ সিস্টেম লস জায়েজ করতে সুবিধাবাদী মহলটি পেট্রোবাংলার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিটিসিএলের সিস্টেম লস হওয়ার কোনো রকম সুযোগ নেই। এ সঞ্চালন লাইনটি এত চাপে থাকে যে, সেটি ফুটো করে বা অন্য কোনো উপায়ে গ্যাস চুরি করা সম্ভব নয়। জিটিসিএল চোরাইপথে কাউকে গ্যাস সরবরাহ করছে, নিজেরা ব্যবহার করছে অথবা যখন পরিমাপ করে নিচ্ছে, সেখানে কম নিচ্ছে। এ ছাড়া সিস্টেম লস হওয়ার সুযোগ নেই।

পেট্রোবাংলা বলছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সিদ্ধান্ত ছিল সিস্টেম লস কমানো। পেট্রোবাংলা দেশি উৎস এবং আমদানি করা গ্যাস মিশ্রণ করে সরবরাহ করে। প্রতি মাসে কী পরিমাণ গ্যাস কেনা হচ্ছে তার হিসাব আছে। আবার বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া যাচ্ছে সেই হিসাবও আছে। সিস্টেম লস কমাতে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জিটিসিএল এবং অন্য কোম্পানির জন্য গ্যাসের মিটার বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রথমে ছয়টি উৎসে মিটার বসানো হয়। দেশি তিনটি, বিদেশি দুটি ও একটি এলএনজি কোম্পানিতে ৪০-এর ওপরে মিটার বসানো হয়। এসব মিটারের মাধ্যমে জিটিসিএল গ্যাস বুঝে নেয়। ছয়টি কোম্পানির কোনো লস নেই। জিটিসিএল এ গ্যাস এনে ছয়টি বিতরণ কোম্পানিকে ৬৪টি পয়েন্টের মাধ্যমে সরবরাহ করছে। তারা কত গ্যাস পাচ্ছে এবং কত বিক্রি করছে সেটার হিসাব স্বচ্ছ এবং সঠিক। আগেও গোঁজামিল দিয়ে করা হতো। এখন জিটিসিএল বলছে, আমরা গ্যাস ট্রান্সমিশন করছি, আমাদের লস হওয়ার কথা না। মিটার বলছে, তাদের দুই থেকে আড়াই শতাংশ লস হচ্ছে। জিটিসিএল যখন উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানিকে দিচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে তিন শতাংশের মতো লস হচ্ছে। মেইনটেনেন্সের পরে তা কমে দুই থেকে আড়াই শতাংশ দেখা যায়। পরে দেখা গেল জিটিসিএল নিজে কিছু গ্যাস ব্যবহার করছে, তা দামের মধ্যে ধরছে না। বিইআরসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পেট্রোবাংলা জিটিসিএলকে এ গ্যাসের দাম দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু জিটিসিএল এ লস মানতে চায় না। তা হলে এ টাকা কে দেবে? জিটিসিএলের এ ক্ষতি পূরণের জন্য ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। সে সময় জিটিসিএলের ট্রান্সমিশন চার্জ ৪৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ০২ টাকা করা হয়। এতদিন এভাবেই চলছিল। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জিটিসিএলের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ইন্ধনে তারা বলছে, এ সিস্টেম লসের টাকা আমরা দেব না। মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হলেও কিছু হয়নি। এখন বিইআরসিকে বিষয়টি জানানো হবে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পাঠানো পেট্রোবাংলার চিঠিতে বলা হয়, গ্যাস মিটারিংয়ের তেমন কোনো ব্যবস্থা আগে ছিল না। ফলে জিটিসিএলের ট্রান্সমিশন সিস্টেমে কারিগরি বা অন্যভাবে গ্যাসের কোনো পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ২০১৮ সালের এক আদেশে জিটিসিএল বিতরণ কোম্পানির ইনটেক পয়েন্টের বিদ্যমান মিটারিং ব্যবস্থা কার্যকর করার নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশের পর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টের (জিটিসিএল বা বিতরণ কোম্পানি স্থাপিত স্টেশন) মিটারিং অনুযায়ী কোম্পানিভিত্তিক গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ বিভাজন করবে। সে অনুযায়ী, বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস বিল (উৎপাদন, সঞ্চালন, আইওসি, এলএনজি, পেট্রোবাংলা ও অন্যান্য চার্জ) যথাসময়ে পরিশোধের ব্যবস্থা করবে বলে সুপারিশ করে। 

চিঠিতে এ নির্দেশ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়। মিটার বসানোর পর গ্যাসের সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর কেনাবেচার একটি পরিসংখ্যান দেখা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে জিটিসিএলের সিস্টেম লস ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ, মার্চে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ এবং এপ্রিলে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে মিটার অনুযায়ী একই বছরের মার্চে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ১০  দশমিক ৭৮ শতাংশ, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ২ দশমিক ০৫ শতাংশ লস হয়েছে। ছয়টি বিতরণ কোম্পানির সামগ্রিক লস ছিল ১৬১ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস।

এ-সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি ২০২৩ থেকে অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে মিটারিং ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ায় মিটারিংয়ের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিগুলোতে সরবরাহ করা গ্যাসের পরিমাণের মধ্যে যে পার্থক্য হচ্ছে তা জিটিসিএলের সিস্টেম লস হিসেবে গণ্য হবে এবং তার কারিগরি ও আর্থিক দায় জিটিসিএল বহন করবে। জিটিসিএলের নিজস্ব গ্যাস ব্যবহার যেমন বিভিন্ন জেনারেটর, থার্মো ইলেকট্রিক জেনারেটরসহ কম্প্রেসারগুলো (মুচাই, আশুগঞ্জ ও এলেঙ্গা) পরিচালনা এবং নিজস্ব আরও গ্যাস ভোগ যদি থেকে থাকে তা জিটিসিএল সংশ্লিষ্ট এলাকার বিতরণ কোম্পানিকে গ্রাহক শ্রেণি অনুযায়ী গ্যাস বিল পরিশোধ করবে এবং জিটিসিএল তা প্রশাসনিক খরচের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবে।

জিটিসিএল বলছে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পেট্রোবাংলা জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে অসৎ উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম লসের নামে গ্যাস চুরির দায়ের সিংহভাগ জিটিসিএলের ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিয়েছে। এর ফলে গত ২৯ বছর ধরে আর্থিক লাভে থাকা কোম্পানিটি বিপুল আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২১২  দশমিক ৩৩ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ ক্ষতির ধারা অব্যাহত থাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান জিটিসিএল আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য মকবুল-ই এলাহী চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, জিটিসিএলের সিস্টেম লস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা হাইপ্রেসারে (১০০০ পিএসআই) গ্যাস সঞ্চালন করে। পাইপে কোথাও সুচ পরিমাণ লিকেজ থাকলে ২০০ থেকে ২৫০ গজ দূর থেকে বিকট আওয়াজ পাওয়া যাবে। ঘটবে বড় দুর্ঘটনা।

তিনি বলেন, জিটিসিএলের সিস্টেম লস কেন হচ্ছে তা তদন্ত করে বের করার পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার সময়ের আলোকে বলেন, মিটার বসানোর ফলে প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে। সিস্টেম লসের টাকা জিটিসিএলকেই দিতে হবে। তাদের আর্থিক লস পোষাতে ট্রান্সমিশন চার্জ ৪৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১  দশমিক ০২ টাকা করা হয়েছে। একটা দুষ্ট চক্র ব্যক্তিগত লাভের জন্য সবচেয়ে স্বচ্ছ অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমটা নষ্ট করবে এটা তো কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এখন থেকে বিইআরসি সব সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা এ বিষয়ে বিইআরসির কাছে যাব। বিইআরসি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত জিটিসিএলকেই এ টাকা দিতে হবে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close