ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

সম্ভাবনাময় জ্বালানি বায়োগ্যাস
প্রকাশ: শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:৫৪ এএম আপডেট: ২১.০৯.২০২৪ ৮:০৭ এএম  (ভিজিট : ২৪৫)
অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে মূলত বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবনযাপনের মধ্যে আজও রয়েছে বিস্তর ফারাক। শহরে প্রধান গৃহস্থালি কাজকর্মে জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুৎ বা এলপি গ্যাসের ব্যবহার স্বাভাবিক হলেও গ্রামগঞ্জে অধিক ব্যয়ভারের কারণে জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুৎ, এলপি গ্যাস বা কেরোসিনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এসবের বিকল্প হিসেবে আজও গ্রামগঞ্জে প্রধান জ্বালানি হিসেবে কাঠ, গাছের পাতা, খড়কুটার ব্যবহার অধিক প্রচলিত। কোথাও স্বল্প পরিসরে গোবরের ঘুঁটের ব্যবহারও প্রচলিত রয়েছে।

গাছপালা উজাড়, বনভূমি হ্রাসের কারণে গ্রামীণ জনপদে আজ জ্বালানি সংকট দেখা দেওয়ায় বায়োগ্যাসকে একটি সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছেন। কারণ বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ যেমন ব্যয়বহুল নয় তেমনি একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট চালানোর প্রধান উৎস গোবর গ্রামগঞ্জে সহজলভ্য। আর জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামীণ জনপদে অনেকেই গবাদিপশু-গরু-ছাগল এবং হাঁস-মুরগি পালন করে থাকেন। পেশা হিসেবে পশুপালন অনেকের জীবনে সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। সূত্র মতে, দেশে প্রতি বছর ১২৪.১৫ মিলিয়ন টন গবাদিপশুর বর্জ্য সৃষ্ট হয় যা দিয়ে বিপুল পরিমাণ বায়োগ্যস এবং প্রাকৃতিক সার উৎপাদন সম্ভব। দেশের ৪৩ কোটি গবাদিপশুর বর্জ্য ব্যবহার করে গ্রামীণ জ্বালানি চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ বায়োগ্যাস উৎপাদিত হতে পারে। এই বায়োগ্যাস দিয়ে রান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জৈব সার তৈরি করা যাবে। এই প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাস উৎসারণ কমিয়ে পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ বায়োগ্যাস প্লান্টের সম্ভাবনা থাকলেও মাত্র ১.৫ লাখ বায়োপ্লান্ট এ পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে বায়োগ্যাস ব্যবহারের পেছনে রয়েছে বেশ পুরোনো ইতিহাস। স্বাধীনতার সূচনালগ্নে দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের অধীনে জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে একটি ৩ ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদনক্ষম বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করে। তখন এর নির্মাণ ব্যয় ছিল মাত্র ১২ হাজার টাকা। পরবর্তীতে জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ছাড়াও বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা বেশ কয়েকটি বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণে উৎসাহী হয়। জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচারে কাটা হয় বিপুল পরিমাণ গাছপালা। উজাড় হয় বনভূমি। দেশ হারায় পরিবেশ ভারসাম্য। ব্যয়বহুল হলেও বর্তমানে জ্বালানি হিসেবে সারা দেশে এলপি গ্যাস প্রসার লাভ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন ও সেচ পাম্প চালাতে ও বাতি জ্বালাতে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ও কয়লা আমদানি করতে হয়। এ জন্য খরচ হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। বাধাগ্রস্ত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কখনো সময়মতো সেচ দিতে ব্যর্থ হলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়। এ পরিস্থিতিতে কাঠের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার শুরু না করা হলে বাংলাদেশে অচিরেই বনভূমি স্বল্পতাজনিত ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে। বায়োগ্যাস ব্যবহারের প্রসার এ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান দিতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে যত সংখ্যক গরু, মহিষ রয়েছে এ ছাড়াও ভেড়া, ছাগল ও হাঁস-মুরগির মতো ছোট ছোট প্রাণীর বিষ্ঠা ও কচুরিপানার মতো জলজ উদ্ভিদসহ জৈব আবর্জনা বায়োগ্যাস উৎপন্নের কাজে ব্যবহার করা হলে বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকট সমাধানে সহায়ক হতে পারে।

অল্প পরিশ্রম এবং স্বল্প ব্যয়ে একটি পারিবারিক বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৭-৮ সদস্যের একটি পরিবারের জন্য ৩ ঘনমিটার বায়োগ্যাস উৎপাদনক্ষম একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের জন্য ২৫০ সেন্টিমিটার ব্যাসের এবং ২২০ সেন্টিমিটার গভীরতার একটি ডাইজেস্টারই যথেষ্ট। এ ধরনের ডাইজেস্টার কূপের তলদেশ হবে অবতল আকৃতির। তলদেশের আনুভূমিক রেখা থেকে অবতলের মধ্যবিন্দুর দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার। তলদেশের মাটি কমপ্যাক্ট বা ঘনীভূত করে ৭.৫ সেন্টিমিটার একটি ইটের সোলিং দিতে হবে যার ওপর ১:৩:৬ অনুপাতে ৫ সেন্টিমিটার পুরু কংক্রিটের ঢালাই থাকবে। এর ওপরে ২১০ সেন্টিমিটার অভ্যন্তরীণ ব্যাস রেখে ১২.৫ সেন্টিমিটার পুরু এবং ২৫ সেন্টিমিটার উঁচু ইটের দেয়াল নির্মিত হবে। কূপের একদিকে হাইড্রোলিক চেম্বারের জন্য ১৫০ সেন্টিমিটার ও ৭৫ সেন্টিমিটার এবং অন্যদিকে ইনলেট পাইপের জন্য ২০ সেন্টিমিটার ও ২৫ সেন্টিমিটার ইটের গাঁথুনি ফাঁকা রাখতে হবে। এ সময় ইনলেট পাইপের মুখে ১৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি আরসিসি পাইপ বসিয়ে রাখতে হবে। হাইড্রোলিক চেম্বারের দেয়ালের দরজার উচ্চতা রাখতে হবে ১ মিটার এবং এর ওপর আরও ৪০ সেন্টিমিটার উঁচু ইটের দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। দেয়ালের ওপরে ১:২:৪ অনুপাতে ৭.৫ সেন্টিমিটার পুরু কংক্রিটের ঢালাই দিতে হবে। ঠিক এর ওপরে ৭.৫ সেন্টিমিটার পুরু এবং ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু আর্চবিশিষ্ট গম্বুজ আকৃতির ডোম নির্মিত হবে। এর উপরাংশে গ্যাস নির্গমনের জন্য ১.২৭ সেন্টিমিটার ব্যাসের ও ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা জিআই পাইপ খাড়াভাবে স্থাপন করে তার ওপর গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ভাল^ সংযুক্ত থাকবে। দেয়ালের ভেতরে নিচ থেকে চেম্বারের মুখ পর্যন্ত ১:৪ অনুপাতে মর্টার প্লাস্টার দিতে হবে। ডোমের ভেতরের দিকে ১:৩, ১:২ এবং ১:১ অনুপাতে সিমেন্ট-বালি ব্যবহার করে তিন স্তর প্লাস্টার করে ৫ থেকে ৬ দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে কিউরিং করতে হবে।

বায়োগ্যাস প্লান্টের ডাইজেস্টার কূপের সঙ্গে দুই স্টেজে ১০০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, ১৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থ, ১১৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা এবং ১৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, ১৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থ এবং ৬০ সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট আয়তকার হাইড্রোলিক কক্ষ তৈরি করতে হবে। কক্ষের দেয়ালের উচ্চতা ৬০ সেন্টিমিটার নির্মিত হলে সøারি নির্গমনের জন্য একটি পথ রাখতে হবে। কক্ষের ভেতরে ১:৪ অনুপাত ব্যবহার করে সিমেন্ট প্লাস্টার দিতে হবে। নির্গমন মুখের ওপরে ৭.৫ সেন্টিমিটার পুরু ইটের দেয়াল নির্মাণ করে তার ওপরে একটি আরসিসি স্ল্যাবের ঢাকনা দিতে হবে যাতে বাইরে থেকে কিছু প্রবেশ করতে না পারে। ইনলেট পাইপের মুখে একটি ৬০ সেন্টিমিটার বর্গাকৃতি ও ১২.৫ সেন্টিমিটার পুরু ইটের গাঁথুনির ট্যাঙ্ক তৈরি করতে হবে এবং এর ভেতরের দিকে ভালোভাবে সিমেন্ট প্লাস্টার দিতে হবে। এভাবে পুরো প্লান্টটি নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে এর চারদিক মাটি ও বালি দিয়ে ভরাট করে দিলে প্লান্টের স্থায়িত্ব ও ব্যবহারে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

বায়োগ্যাস প্লান্টে জ্বালানি উৎপাদনের জন্য প্রথমত ১.৫ থেকে ২ টন গোবর, মানুষ ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠার সঙ্গে ১:১ থেকে ১:৩ অনুপাতে পানি মিশিয়ে ইনলেট পাইপ দিয়ে আস্তে আস্তে ডাইজেস্টার কূপে ঢেলে দিতে হবে। এ সময় কোনোরূপ মাটি বা ইট-পাথর ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ গোবরে কূপটি পূর্ণ না হলে বাকি অংশ পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে। কূপের মধ্যস্থিত পচনশীল দ্রব্য থেকে ধীরে ধীরে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়ে জিআই পাইপের মধ্য দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে এবং পাইপ সংযোগের মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যেতে হবে। সংযুক্ত ভাল্বের সাহায্যে গ্যাসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ গ্যাস থেকে চুলা জ্বালিয়ে রান্নার কাজ করা এমনকি বৈদ্যুতিক বাল্ব ও হ্যাজাক লাইট জ্বালানো, জেনারেটর, ফ্যান, রেডিও, টেলিভিশন চালানো সম্ভব হবে। ডাইজেস্টার কূপে উৎপন্ন বায়োগ্যাস ব্যবহারের পর কূপের নিচে জমাকৃত বর্জ্য থেকে উন্নত মানের জৈব সার প্রস্তুত করে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি এসব বর্জ্য হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। 

বর্তমান জ্বালানি সংকট সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের মানুষের জন্য স্বস্তি এনে দিতে পারে। শহরাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ বর্জ্য আবর্জনা দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপন্ন সম্ভব। এ কাজে পোল্ট্রি শিল্পের বর্জ্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, ১.২ থেকে ১.৩ ঘনমিটার সামর্থ্যরে বায়োগ্যাস প্লান্ট দিয়ে গৃহস্থালি এবং মাঝারি আকারের গবাদিপশু পালন ফার্মের চাহিদা মেটানো সম্ভব। দেশে প্রায় ২২ মিলিয়ন গরু এবং মহিষ রয়েছে যা থেকে ০.২২ মিলিয়ন টন গোবর মেলে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৩ জেলার প্রায় ১ মিলিয়ন পশুপালনকারী মানুষের জীবিকা নির্বাহের কাজে দুধ এবং মাংস বিক্রির বাইরেও পশুর বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস জ্বালানি উৎপাদনসহ পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। 
বায়োগ্যাস ব্যবহারের প্রসার লাভের লক্ষ্যে প্লান্ট স্থাপনের জন্য জনগণকে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদানসহ দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি জোরদার করা জরুরি। 
এ ক্ষেত্রে বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় হ্রাসের ব্যাপারেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কথাও বিবেচনায় আনা দরকার। একটি পারিবারিক বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে কতটা রান্নার চুলা জ্বালানো যায় এবং তা দিয়ে পরিবারের কতজন সদস্য উপকৃত হতে পারে সে ব্যাপারে তাদের বিশদ ধারণা দেওয়া জরুরি। আজকের দিনের বায়োগ্যাসের চাহিদার চেয়ে ২০৪০ সাল নাগাদ কম ব্যয়ে ৫০ শতাংশ বেশি বায়োগ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনা বাংলাদেশে রয়েছে। জ্বালানি কাঠের চেয়ে বায়োগ্যাস ব্যবহারের কারিগরি সুবিধার বিষয়ে গ্রামীণ জনগণ অবহিত হলে এর ব্যবহারের প্রসার লাভ সম্ভব হবে।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close