মানবজাতির ইতিহাসে যুদ্ধ এক নির্মম অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসেও যুদ্ধ একটি বড় উপাদান। সভ্যতার আদি থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ লেগেই আছে। সভ্যতা যত এগিয়ে গেছে যুদ্ধ বা যুদ্ধাস্ত্র তত আধুনিক হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় উৎকর্ষ প্রযুক্তির এ পৃথিবীতে যুদ্ধ এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। তারই সংযোজন হলো হাইব্রিড যুদ্ধ। যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে এক বা একাধিক দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে চলে আসছে হাইব্রিড যুদ্ধ।
সম্প্রতি লেবাননে একের পর এক নিত্যব্যবহার্য প্রযুক্তিপণ্যের বিস্ফোরণও প্রকারান্তরে হাইব্রিড যুদ্ধের অংশ। এরই মধ্যে রাশিয়া এই ঘটনা হাইব্রিড যুদ্ধের অংশ বলে মন্তব্য করেছে। দেশটির জায়গায় জায়গায় খুদেবার্তা পাঠানোর পেজার, রেডিও বিস্ফোরণে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে। এমনকি লেবাননজুড়ে পেজার, ওয়াকিটকির পাশাপাশি ল্যাপটপ, রেডিও, গাড়ি, এমনকি সোলার প্যানেলে বিস্ফোরণের সংবাদও পাওয়া গেছে। এসবের পেছনে যে ইসরাইল দায়ী তা অনেকটাই প্রকাশ্য। এমন অনভিপ্রেত ঘটনায় হতভম্ব লেবানিজরা। হাইব্রিড যুদ্ধের সংজ্ঞায় ইউরোপীয় সেন্টার অফ এক্সিলেন্সের পরিচালক তিজা টিলিকাইনেন বলেন, এখন অব্দি এসব হুমকি এতটাই ঘোলাটে, অদৃশ্য এবং অনির্ধারিত যেকোনো দেশের পক্ষেই এ ধরনের হুমকি মোকাবিলা করা অত্যন্ত জটিল এবং দুরূহ কাজ। বুঝতে পারেনি হিজবুল্লাহ ও লেবানিজরাও।
হিজবুল্লাহ ক্রমেই ইসরাইলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে তা আগেই বুঝে ফেলেছিল ইসরাইল। আর তাই তৎপর হয়ে ওঠে মোসাদ। তাদের নজরদারি এড়াতেই আধুনিক প্রযুক্তির স্মার্টফোন ব্যবহার করত না হিজবুল্লাহ সদস্যসহ সাধারণ লেবানিজরাও। আর তাই ছোট্ট পেজারকেও বোমা বানিয়ে ছেড়েছে দুর্ধর্ষ ইসরাইলি গোয়েন্দারা। বাদ রাখেনি ওয়াকিটকি, ল্যাপটপ, রেডিও কিংবা সোলার প্যানেলও। মূলত হিজবুল্লাহকে ঠেকাতে গিয়ে ইসরাইল পুরো লেবাননের বিরুদ্ধেই হাইব্রিড যুদ্ধে মেতে উঠেছে। কেননা ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এরই মধ্যে জানিয়েছেন, নতুন যুগে পা রাখছে এই যুদ্ধ। এর মাধ্যমে হামলায় সম্পৃক্ততার ব্যাপারটি একরকম স্বীকার করল ইসরাইল। গত মঙ্গলবারের বিস্ফোরণ নিয়ে শুরুতে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও গতকাল বৃহস্পতিবার উত্তর ইসরাইলের এক বিমান ঘাঁটি পরিদর্শনের সময় বিষয়টি উল্লেখ করেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট। তিনি বলেন, এই যুদ্ধের নতুন যুগে প্রবেশ করছি আমরা। এর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে।
দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিনবেত ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে নিয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) তৎপরতার প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমরা দারুণ সুফল পেয়েছি। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদন অনুসারে, গত মঙ্গলবারের অভিযানটি ছিল আইডিএফ ও মোসাদের যৌথ প্রচেষ্টা। তবে গ্যালান্টের বক্তব্যের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোনো ইসরাইলি কর্মকর্তা এই জোড়া হামলায় দেশটির ভূমিকার কথা স্বীকার করলেন। ইসরাইলের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, পেজারে বিস্ফোরক থাকার ব্যাপারটি হিজবুল্লাহ জেনে ফেলায় তড়িঘড়ি করে ইসরাইল এই হামলার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইসরাইল এর আগেও এ ধরনের হামলায় জড়িত ছিল। ১৯৯৬ সালে হামাস বোমা প্রস্তুতকারক ইয়াহিয়া আয়্যাশকে একটি বিস্ফোরক যুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছিল। তবে লেবাননে সম্প্রতি সংঘটিত হাজার হাজার ডিভাইসের বিস্ফোরণ ছিল নজিরবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটির মার্ককুলা সেন্টার ফর অ্যাপ্লাইড এথিকসের প্রযুক্তি নীতিশাস্ত্রের পরিচালক ব্রায়ান প্যাট্রিক গ্রিন বলেন, কীভাবে হাজার হাজার ডিভাইস অস্ত্রে রূপান্তরিত হলো, তা কেউই টের পেল না। এই বিস্ফোরক ডিভাইসগুলো কতটা ছড়িয়ে আছে? কীভাবে এই বিস্ফোরকগুলো ডিভাইস বা সরবরাহ নেটওয়ার্কে ঢুকে গেল? এই আক্রমণ ভীতিকর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যা আগে কখনো বিবেচনায়ই নেওয়া হয়নি।
সবমিলিয়ে আগ্রাসী ইসরাইল যে লেবাননের বিরুদ্ধে হাইব্রিড যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে তা আর কারও বুঝতে বাকি নেই। এমনই এক যুগের মধ্যে এমন কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে যা হাইব্রিড যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বাল্টিক সাগরে ডেনমার্ক ও সুইডেনের উপকূলের মাঝামাঝি জায়গায় এক বিস্ফোরণের ফলে নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে বড় ধরনের ছিদ্র তৈরি হয়। রাশিয়া থেকে গ্যাস জার্মানিতে নেওয়ার জন্য এই পাইপলাইন তৈরি করা হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই রাশিয়া জানায়, তারা এর পেছনে নেই। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের কারণে তাদের শায়েস্তা করতে রাশিয়াই এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করে। এর ফলে যাতে ইউরোপ জ্বালানি সংকটে পড়ে।
এছাড়া নির্বাচনে গোপন হস্তক্ষেপের ঘটনাও হাইব্রিড যুদ্ধের উদাহরণ হতে পারে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া তদন্তে দেখা গেছে, রাশিয়া সুপরিকল্পিতভাবে ওই নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ের সম্ভাবনাকে কমিয়ে ফলাফল ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুকূলে নিয়ে আসা। তবে তদন্তের এই ফলাফল তারা সবসময় অস্বীকার করেছে।
হাইব্রিড যুদ্ধের আরেকটি কৌশল হচ্ছে, কোনো বিষয় বা ঘটনার একটি কাল্পনিক, মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা তৈরি করে প্রচার করে যাওয়া, যাতে সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সম্প্রতি ইউক্রেনে হামলার পর অনলাইনে এ ধরনের প্রচার বেড়েছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য এই হামলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল বলে মস্কো যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা শুধু রাশিয়া ছাড়া পুরো ইউরোপের অনেক মানুষই বিশ্বাস করে।
সময়ের আলো/আরএস/