ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

সিনেমা-নাটকে বন্যপ্রাণী আইন পালন করতে হবে
প্রকাশ: শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:৫৪ এএম আপডেট: ২৯.০৯.২০২৪ ৭:৫৭ এএম  (ভিজিট : ৭১)
কাহিনির প্রয়োজনেই মাঝেমধ্যে নাটক বা সিনেমায় পাখিকে খাঁচায় বন্দি দেখানো হয়। আর এসবকে কেন্দ্র করে মামলাও করতে দেখা যায় বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটকে। বন্যপ্রাণী আইনে এ মামলা করা হয়। ২০২২ সালে ‘শেষ গল্পটা তুমিই’ নাটকে খাঁচাবন্দি টিয়া পাখি এবং ‘হাওয়া’ সিনেমায় খাঁচাবন্দি শালিক পাখি দেখানো ও পাখিকে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্যটি নিয়ে তখন বেশ আলোচনার জন্ম হয়। 

এমনকি হাওয়া সিনেমা নিয়ে উদ্বেগও জানায় পরিবেশবাদী ৩৩টি সংগঠন। একই সঙ্গে সিনেমার দৃশ্যটি সংশোধন করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য তারা পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীর প্রতি আহ্বান জানান। ফলে চারদিকে এ নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। তবে গল্পের প্রয়োজনে এমন দৃশ্য রাখতে হলে কী করবেন তারা? এমন প্রশ্নও উঠে আসে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর একটি জোটের দাবি ছিল, হাওয়া সিনেমার কয়েকটি দৃশ্য আছে, যা বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত এ ধরনের অপরাধের ফলে সাধারণ মানুষ পাখি শিকার, খাঁচায় পোষা ও হত্যা করে খাওয়ায় উৎসাহিত হয়। এ জন্য বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী আটকে রাখা, হত্যা করার মতো অপরাধ দমনে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট নামে একটি বিভাগ আছে। ওই বিভাগের কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আইন অনুযায়ী শালিক একটি সংরক্ষিত প্রাণী। এ জাতীয় পাখি বা প্রাণী খাঁচায় আটকে শুটিং বা প্রদর্শন করতে হলে বন বিভাগের অগ্রিম অনুমতি থাকতে হয়। বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে বন বিভাগ আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বা সাজা চেয়ে মামলা করতে পারে।’ ফলে সিনেমা বা নাটক নির্মাণের আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি নেওয়া অবশ্যই জরুরি। যদিও সিনেমা বা নাটকের শুরুতে ‘শুটিংয়ের সময় পরিবেশ বা প্রাণীর কোনো ক্ষতি করা হয়নি’ বলে উল্লেখ করা হয়।

আমরা জেনেছি, ‘শেষ গল্পটা তুমিই’ নামের একটি নাটকে খাঁচাবন্দি টিয়া পাখি দেখানোর ৪৫ সেকেন্ডের দৃশ্য থাকায় পরিচালকের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ১৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করা হয়। এখন কথা হচ্ছে-কম বাজেটের একটি কাজের জন্য এত টাকা ক্ষতিপূরণ কীভাবে সম্ভব হতে পারে? এমন হলে নির্মাতারা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। যা শিল্প-সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ বিবেচিত হবে। ওই নাটকে ‘বন্যপ্রাণী আইন ২০১২’ ভাঙার অভিযোগ ওঠে নির্মাতা অনন্য ইমনের বিরুদ্ধে। এতে নাটকটির চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক অনন্য ইমনের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ দাবি করে উচ্চ আদালতে মামলা করে সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট’।

তখন মামলার বিষয়ে পরিচালক অনন্য ইমন বলেছিলেন, ‘নাটকের চিত্রনাট্যে এমন কোনো দৃশ্য ছিল না। যে বাড়িতে শুটিং করেছি সেখানেই ছিল টিয়া পাখিটি। দৃশ্যায়নের সময় মনে হলো নায়ক কোনো একটা কাজ করতে করতে মা ও বোনের সঙ্গে কথা বললে দৃশ্যটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে দর্শকের কাছে। তা ছাড়া এখানে পাখিকে আদর করে খাওয়ানো হচ্ছে, এটি নিয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ে যাব, ভাবনাতেই আসেনি। একই সঙ্গে দৃশ্যটিতে নায়কের মা গাছে পানি দিচ্ছিল, পাখিবন্দি দেখানোয় যদি কপালে তিরস্কার জোটে, তবে গাছে পানি দিতে সবাইকে উৎসাহিত করার জন্য আমার পুরস্কার পাওয়া উচিত।’

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর ওই অভিযোগের বিষয়ে হাওয়া সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বলেছিলেন, ‘সিনেমায় একটি নেতিবাচক চরিত্রকে উপস্থাপনের জন্য চলচ্চিত্রে খাঁচায় রাখা শালিক পাখি ও সেটিকে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু খাওয়ার দৃশ্যটি আসল নয়।’ সিনেমায় পাখিটিকে একবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাখিটি কিনারা খুঁজে না পেয়ে আবার ফিরে আসে। তবে পাখিটিকে হত্যা করার কোনো দৃশ্য দেখানো হয়নি। বিষয়টি দর্শককে পাখি শিকারে বা হত্যায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে বলে মনে হয়নি।

এর আগেও বাংলাদেশের একটি বড় মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনচিত্রে খাঁচাবন্দি টিয়া পাখি দেখানোয় ২০২১ সালের জুলাই মাসে মামলা করেছিল বন বিভাগ। এরপর ওই কোম্পানি বিজ্ঞাপনচিত্রটি সরিয়ে নেয়। আর পাখি ধরার খাঁচা বিক্রির অভিযোগে বড় একটি অনলাইন পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়। তবে সরাসরি বন্যপ্রাণী আটকে রাখা বা উদ্ধার হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা বা কারাদণ্ড দেওয়ার উদাহরণ আছে। সেটিকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। এতে মানুষ আরও সচেতন হবে। সে ক্ষেত্রে পাখি বিক্রির দোকানে সংরক্ষিত পাখি আছে কি না, তাও খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত। কেননা পাখি পোষার শখ অনেকেরই আছে।

তার আগে আমাদের জানতে হবে, বন্যপ্রাণী আইনের ৬ ধারা মোতাবেক এ আইনের তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকার বা বন্যপ্রাণী, মাংস, ট্রফি, অসম্পূর্ণ ট্রফি, বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ অথবা এসব থেকে উৎপন্ন দ্রব্য দান, বিক্রয় বা কোনো প্রকারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের ৪১ ধারা মোতাবেক আরও উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা ওই অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দিয়ে থাকলে এবং ওই সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, ওই সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী তার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আইনের ৩৬ ও ৩৭ ধারায় বাঘ, হাতি, চিতাবাঘ ইত্যাদি সংক্রান্ত অপরাধ করলে আইনের ৩৬ ধারায় দণ্ড সর্বনিম্ন দুই বছর, সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন ১ লাখ, সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। সংরক্ষিত উদ্ভিদ সংক্রান্ত ৬নং ধারা লঙ্ঘন করলে ৩৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এক বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে।

বন্যপ্রাণী আইন সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই। যুগ যুগ ধরে সিনেমা-নাটকে এমন দৃশ্য দেখেই অভ্যস্ত দর্শকরা। আর যেহেতু সিনেমা নির্মাণের পর সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে হয়। তারা দেখে তারপর মুক্তি দেন। সে হিসেবে প্রথমত সেন্সর বোর্ডের অদূরদর্শিতার বিষয়টি উঠে আসে। এমন একটি আইনবিরোধী কাজ থাকলে সেটি মুক্তি পায় কীভাবে? তাই সেন্সর বোর্ডে আইনবিদ, পরিবেশবিদ রাখা জরুরি। এ ছাড়া বন্যপ্রাণী আইনে সিনেমা-নাটকের বিষয়টিও উল্লেখ করা যেতে পারে। তাতে ভবিষ্যৎ নির্মাতারা সতর্ক হয়ে যাবেন। কারণ সবাইকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। 

বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন দেশের নির্মাতারাও! নির্মাতা শিহাব শাহীন বলেছিলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। আইনে যেসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; সেসব অবশ্যই মেনে চলা উচিত। তবে ঠিক কোন বিষয়গুলো পর্দায় উপস্থাপন করা যাবে না-এ ব্যাপারে একটা নির্দেশনা আমাদের জন্য থাকা উচিত। কেননা একজন মানুষের তো আর আইনের সব দিকগুলো মাথায় নিয়ে ঘোরা সম্ভব না।’ তিনি মনে করেন, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর ক্ষোভ শুধু নাটক-সিনেমার ক্ষেত্রেই। শুধু নাটক-সিনেমার ক্ষেত্রে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর এমন সরব ভূমিকা দেখে এ নির্মাতাও অবাক হয়েছিলেন। লাভলু আরও বলেছিলেন, ‘বাস্তব জীবনে অনেকেই খাঁচায় বন্দি করে পশু-পাখি পুষে থাকেন। কিন্তু সেসব বন্ধে সরব না হয়ে শুধু পর্দায় এমন দৃশ্য দেখলে তারা কেন সরব হন-এই প্রশ্ন আমারও। আমি এর কারণ খুঁজে পাই না।’

তবে বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার পর ‘হাওয়া’ সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে করা মামলাটি প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করা হয়। মামলার বাদী সরকারি কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়। তবে আমাদের এসব সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। 

সিনেমা-নাটকে নেতিবাচক অনেক কিছুই তুলে ধরা হয়। সেসব ক্ষেত্রে ‘দেখানো উচিত নয়’ বললে শিল্পমাধ্যমই মুখ থুবড়ে পড়বে। মূলত সব ধরনের শিল্পেরই একটি বার্তা থাকে। আমি নিশ্চিত, হাওয়া সিনেমা দেখার পর কেউ দেদার শালিক শিকার শুরু করেননি। তারা হয়তো বিষয়টি ভুলেই গেছেন। মামলার মাধ্যমে বিষয়টি আলোচনায় আনা হয়েছিল। এ কথাও সত্য যে, আইনের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা হলে মানুষ সচেতন হবে। আইন পালনে সচেষ্ট থাকবে। আশা করি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বার্তা নির্মাতাদের কাছে পৌঁছবে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন। উভয়ের কল্যাণে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত আমরা আশা করতেই পারি।

গণমাধ্যমকর্মী

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close