ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ধামরাইয়ে মাজারে হামলা-ভাংচুর, ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮:৪১ এএম  (ভিজিট : ৪২৬)
ঢাকার ধামরাইয়ের বাটুলিয়া এলাকায় একটি মাজারে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়দের কাছে এটি আধ্যাত্মিক সাধক বুচাই পাগলার মাজার হিসেবে পরিচিত। ভাংচুরকারীদের দাবি, ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড ও মাদকের ছড়াছড়ির কারণে স্থানীয় বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ আলেম ওলামারা এটি ধ্বংস করেছেন।

যদিও এলাকাবাসীর বলছেন, এই মাজারে শরিয়া বিরোধী কাজকর্ম হতো না। মাজারে মাদক নিষিদ্ধ ছিল। মাজারের টাকায় একটি মসজিদ পরিচালনা, মাদরাসায় অর্থ দেওয়াসহ অসহায় মানুষদের সহায়তা করা হতো। মাজারে হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার সানোড়া ইউনিয়নের বাটুলিয়া এলাকায় কালামপুর-সাটুরিয়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে মাজারটিতে ভাংচুর করে প্রায় পাঁচ শতাধিক আলেম ওলামা। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত ভাংচুর চলতে থাকে। মাজার ভবনটি খননযন্ত্র (ভেকু) দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। বেলা আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনী, উপজেলা প্রশাসন এসে ভাংচুরকারীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর তাদের বুঝিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এক কক্ষে মাজারটির ভবনটির তিনটি দেয়ালের ইট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবনের চারপাশে সীমানা দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। ছাদে মোট পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে, এরমধ্যে চার কোনায় থাকা চারটির মধ্যে তিনটি গম্বুজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এরমধ্যে দুটি গম্বুজ ছাদেই ফেলে রাখা দেখা যায়। মাজারের পাশে থাকা একটি টিনের কক্ষ ভাংচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে থাকা সব মালামাল লুটপাট করা হয়েছে। মাজারের অদূরে থাকা আরও একটি টিনের কক্ষ ভাংচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশে থাকা অপর একটি ভক্তদের বিশ্রামের জন্য তৈরি করা সেমি পাকা ভবনে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, বাটুলিয়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন বুচাই পাগলা। কিশোর বয়সেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তবে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক নানা গুণ ছিল। এ কারণে ধীরে ধীরে তার ভক্ত অনুসারী তৈরি হয়। ৮০র দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। এরপর বাটুলিয়ার সড়কের পাশে কবরস্থানের সামনে তাকে দাফন করা হয়। ওই কবরকে ঘিরেই মাজার গড়ে ওঠে। প্রতি বছর সেখানে ওরশ ও মাসব্যাপী মেলা আয়োজন করা হয়। বাউল গানসহ নানা আয়োজন থাকে সে আয়োজনে। সেখানে দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেয়। তবে স্থানীয় মুসল্লীরা সেখানে ধর্ম বিরোধী কাজকর্ম হয় বলে অভিযোগ করে আসছিল। এরই জেরে বুধবার সেখানে হামলার ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভাংচুরকারীরা জানান, গত কয়েক দিন ধরেই ধামরাই আলেম ওলামারা মাজারটি গুঁড়িয়ে দিতে আলাপআলোচনা করছিলেন। এরই জেরে ধামরাইয়ের ইসলামপুর, কালামপুর, কুশুরাসহ আশপাশের কয়েকটি মাদরাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও ইমামরা জড়ো হয়ে মাজারটিতে হামলা করেন।

দুপুর থেকে এ হামলায় অংশ নিয়েছিলেন কুশুরা দক্ষিণ কান্টাহাটি মসজিদের ইমাম মাওলানা মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখানে শেরেক বেদাতি কাজকর্ম চলছিল। তবে কোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে পারছিলাম না। আলহামদুলিল্লাহ এখন প্রতিরোধ করার সময় হয়েছে। এখন যদি বসে থাকি, তবে কেয়ামতের ময়দানে হিসাব দিতে হবে। যে কারণে আমরা ধামরাইয়ের আলেম ওলামারা বিভিন্ন সংগঠন থেকে একত্রিত হয়ে এটি বন্ধ করি। ধামরাই ওলামা পরিষদ, ইমাম পরিষদ, কালামপুর আঞ্চলিক ইমাম পরিষদ এখানে ছিল।’

এ হামলার সমন্বয় করেছেন বলে পরিচয় দেওয়া আবুল কাশেম বলেন, ‘এখানে অনেক আগে থেকে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড হয়েছে। তবে জনগণ প্রতিবাদ করতে পারেনি। এখানে মদ, গাঁজাসহ, নানা অনৈতিক কাজ হতো। কালামপুর ও আশপাশের তৌহিদি জনতা সবাই একত্র হয় ও এটি ধ্বংস করে।’

এদিকে এ হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলছেন, এই মাজারে শরিয়া বিরোধী কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হতো। মাজারে সিজদা করতে দেওয়া হতো না। নির্দেশনা টাঙানো ছিল। মাজারের দানবাক্স সপ্তাহে এক দিন জনসমক্ষে খোলা হতো। দানের অর্থে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। ইমামের বেতন দেওয়া হতো মাজারের অর্থে। এছাড়া অসহায় দরিদ্রদের আর্থিক সহযোগিতা, মাদরাসায় আর্থিক সহায়তাসহ মানুষের কল্যাণে এই অর্থ ব্যয় করা হতো। 

স্থানীয়দের ভাষ্য, এলাকাবাসী এ মাজারের বিরুদ্ধে নয়। তারা কোনো অভিযোগ করেননি। মাজার নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে উপজেলা প্রশাসন কিংবা প্রশাসনের অভিযোগ করতে পারতো। এভাবে অতর্কিত ভাংচুরকে  অন্যায় বলে অভিহিত করেছেন তারা।

মাজারের বিপরীত দিকে বাড়িটি মো. তারা মিয়ার (৮৮), তার ঠিক পাশের বাড়িটি জাহাঙ্গীর আলমের (৫৫)। তারাসহ আরও প্রায় ১০-১২ জন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাজারের সামনে সড়কের পাশে। কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা বলছেন, এত বছর ধরে মাজার চলছে। মাজারে গানবাজনা হয় বছরে এক মাস। এছাড়া আর কিছু হয় না। মাজারের দানবাক্সের হিসাব স্বচ্ছ। দানের টাকা গরিব মানুষের সহযোগিতায় ব্যয় করা হয়। এরপরও মাজারটি তারা ভাঙলো। এলাকার লোকজন আগে  থেকে জানলে প্রতিরোধ করতো। তারা অতর্কিত হামলা করলো।

ক্ষুব্ধ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এলাকার একটা লোকও মাজার ভাঙার সঙ্গে ছিল না। তারা কেউ বুঝতেই পারেনি। এই মাজারে শরিয়া বিরোধী কোনো কাজকর্ম করতে দেয়নি আমরা। মাদক সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল। পুলিশ প্রশাসন সার্বক্ষণিক মাজারে নিরাপত্তা দিয়েছে। দূরের লোকজন এসে যেভাবে মাজার ভাঙলো এটা অন্যায়। আল্লাহ এর বিচার করবেন।’

বৃদ্ধ তারা মিয়াও ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘ওরা যেভাবে এসেছে, আমরা বুঝলে এলাকাবাসী প্রতিবাদ করতাম। এলাকার কেউই মাজার ভাঙতে দিত না।’

মাজারের পাশেই ভাংচুর ও গুঁড়িয়ে দেওয়া টিনের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন বাটুলিয়া এলাকার অন্তত অর্ধ শতাধিক বাসিন্দা। তারাও এ ভাংচুরের ঘটনাকে অন্যায় আখ্যা দিয়ে বলেন, নবীজি তো বিধর্মীকেও রক্ষা করতেন। তাদের যদি ক্ষোভ থাকতো, আমাদের বলতো। এই মাজারের টাকা তো মাদরাসায়ও দেওয়া হয়। মসজিদ পরিচালনা করা হয় মাজারের টাকায়। তারা কিভাবে মাজারটি এভাবে ভাঙলো। মাজার তো কাউকে ডেকে আনে না। ভক্ত, অনুসারীরা নিজের ইচ্ছায় আসে। কাউকে তো হয়রানি করা হয় না। তারা মাজার ভেঙে ইসলাম বিরোধী কাজ করেছে। এলাকার কেউ কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি, এভাবে এটি ভাংচুর করা হবে।

মাজারের অর্থে পরিচালিত বাবা বুচাই চান পাগলা জামে মসজিদে গত ১২ বছর যাবত ইমামতি করছেন একটি মাদরাসা থেকে পড়াশোনা করা মাওলানা মো. সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এই মাজারে শরিয়া বিরোধী কর্মকাণ্ড আমরা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতাম। সিজদা করতে দেওয়া হতো না। মাজারের দানবাক্সের টাকা মানুষের জন্য ব্যয় করা হতো। তারা যেভাবে এটি ভাংচুর করেছে, এটাই ইসলাম বিরোধী কাজ। এলাকার মানুষ খুবই কষ্ট পেয়েছে।’

সানোড়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. তিতুমীর হোসেন বলেন, ‘তারা অতর্কিতে এসে ভাংচুর করেছে। ইউএনও স্যারের ফোন পেয়ে দুইজন চৌকিদার নিয়ে এখানে এসেছিলাম। তবে তাদের সামনে যেতে পারিনি। পরে সেনাবাহিনী এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এই হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় অন্তত দেড় থেকে দুই কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।’

অন্যদিকে ভাঙচুরের ঘটনার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে আসে সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন। বিকেলের দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় ধামরাই থানা পুলিশ। সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন ভাংচুরকারীদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে অবহিত হয়। পরে তাদের সঙ্গে মঙ্গলবার আবারও উপজেলা প্রশাসন বৈঠক করবে বলে জানায়। এরপর ভাংচুরকারীদের বুঝিয়ে তাদের ওই এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়।

ধামরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি প্রশান্ত বৈদ্য বলেন,‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। দুপুরের দিকে তারা এখানে আসেন। তারা কিছু দাবিদাওয়া জানিয়েছেন। তাদের সঙ্গে ইউএনও মহোদয় মঙ্গলবার বৈঠক করবেন। আপাতত তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’


সময়ের আলো/এএ/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close