ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

আশীর্বাদের নদী বুড়িগঙ্গা আজ দূষণে আক্রান্ত
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:২৪ এএম আপডেট: ১২.০৯.২০২৪ ৭:৫৬ এএম  (ভিজিট : ২০৫)
ঢাকায় বাস করেন তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না, রাজধানী হিসেবে ঢাকার বয়স চারশ বছর পেরিয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। এতগুলো বছরে ঢাকাকে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ঢাকাকে রাজধানী শহর হিসেবে নির্বাচনের পেছনে বুড়িগঙ্গা প্রধান ভূমিকা রেখেছে।

শুরু থেকে মোগল শাসনের সময় থেকে ঢাকার চারদিকে ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গার অর্থনৈতিক, জলযান চলাচল এবং নিরাপত্তার বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় এসেছে। ইরাকের রাজধানী হিসেবে বাগদাদের তীরঘেঁষে প্রবাহিত দজলা, মিসরের রাজধানী কায়রোর পাশে নীলনদই মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং মিসরীয় সভ্যতার যেমন গোড়াপত্তন ঘটেছে তেমনই বুড়িগঙ্গাকে ব্যবহার করেই ঢাকার ইতিহাস, জীবনযাত্রা, শিল্প এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে। রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরের বয়স চারশ বছর পূর্তিকালে এক তথ্যানুসারে বুড়িগঙ্গা তীরে অবস্থিত সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালকে দিয়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন অংশে আসা-যাওয়া করে। এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। শত শত বছর ধরে বুড়িগঙ্গাকে যথেচ্ছ নির্মমতার শিকার হতে হয়েছে। রাজধানী ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের কারণে এককালের সম্ভাবনাময় বুড়িগঙ্গা আজ মৃতপ্রায়।

বুড়িগঙ্গাকে অকার্যকর করার প্রক্রিয়া মূলত নতুন নয়। এ অবস্থার শুরু হয়েছে সেই ব্রিটিশ শাসনামল ১৯১৭ সাল থেকে। এরপরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে বুড়িগঙ্গাকে পুনরুদ্ধারের নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও কার্যত তা সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু বুড়িগঙ্গার পানির ক্রমাগত দূষণের ফলে বুড়িগঙ্গার ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য মানুষের জীবন ধারণাকেই পাল্টে দিয়েছে। আজ রাজধানী ৪ মিলিয়ন মানুষ বুড়িগঙ্গা দূষণের নির্মম শিকার। বুড়িগঙ্গায় চলাচলকারী নৌযানের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতিকে করেছে বাধার সৃষ্টি। নৌযানের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিক, সদরঘাটের হকারদের জীবন ও জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মৎস্যজীবী এবং ধোপা সম্প্রদায়ের পেশায় এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ঢাকা নগরীর কঠিন বর্জ্য, শিল্প-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, নৌযানের ব্যবহৃত তেলের মিশ্রণে বুড়িগঙ্গার পানি আজ ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নদীর পাড় দখল করে বাসগৃহ ও কারখানার অবকাঠামো এবং ইটভাটা নির্মাণের কারণে নদীর গতিপথ হয়ে পড়েছে সংকুচিত।

পানির ভৌত এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বিচার করেই এর কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা হয়। পানির বিশেষত্বের মধ্যে রয়েছে পানির তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং পানির মধ্যস্থিত বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ । পানির ভৌত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে এর স্বচ্ছতা, স্বাদ, গন্ধ, রং, ঘোলাত্ব, তাপমাত্রা এবং বিদ্যুৎ পরিবাহিতার মতো বিষয়। আর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যে থাকে পানির পিএইচ মান, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যালকালি, ক্লোরাইড, সালফেট, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, লৌহ, কার্বন, দ্রবীভূত অক্সিজেন চাহিদা । জীববিষয়ক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পানির মধ্যস্থিত অ্যারোবিক ব্যাকটেরিয়া, অ্যানঅ্যারোবিক ব্যাকটেরিয়া এবং ফ্যাকুলেটিভ ব্যাকটেরিয়া। 

ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিয়মনীতিকে অগ্রাহ্য করে নৌযান থেকে বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে তুরাগ ও বুড়িগঙ্গায়। বিআইটিএ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে নদী খননকালে বিপুল পরিমাণ পলিথিন বর্জ্য পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গার তলদেশে। এমনকি নদীর পাড়ের দালানকোঠা ভাঙা ইট, পাথর, জমাটবাঁধা সিমেন্টের মতো ভারী বস্তুরও সন্ধান মেলে। তথ্য বলছে, রাজধানীর মানুষ প্রতিদিন ৪ হাজার ৫০০ টন কঠিন বর্জ্য এবং ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এ ছাড়া যান্ত্রিক জলযানের পোড়া তেল মবিলে পূর্ণ রয়েছে বুড়িগঙ্গার পানি। বুড়িগঙ্গা পাড়ের হাটবাজারের পচনশীল পদার্থের ভারে দূষিত নদীর পানি। এমনকি বিষাক্ত হাসপাতাল বর্জ্যও রয়েছে বুড়িগঙ্গায় পানিতে। পত্রিকার ২০০৯ সারের এক তথ্য মতে, ১৯৯৭ সালের ‘এনভায়রনমেন্ট কলজারভেশন রুল’ না মেনে প্রায় সাত হাজারেরও বেশি টেক্সটাইল, মেটাল, কেমিক্যাল, রাবার, সিমেন্ট, চামড়া, সার, পাল্প এবং ওষুধ শিল্প-কারখানা থেকে প্রতিদিন ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি দূষিত তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে। আজ এই পরিমাণ কত হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। বুড়িগঙ্গা-তুরাগের পানিতে দূষণের প্রবাহে লক্ষ্য করা যায়, গাজীপুর এলাকার শিল্পবর্জ্য প্রথমে তুরাগে এসে পড়ে এবং ঢাকায় পৌঁছে তা টঙ্গী খালে মিলিত হয়ে সাভার এবং টঙ্গীর বর্জ্য বয়ে নিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞগণ নদী দূষণের উৎস হিসেবে ঢাকা এবং এর আশপাশের যেসব স্থানের শিল্পবর্জ্য চিহ্নিত করেন তা হলো-ঢাকা এক্সপোর্টিং জোন, টঙ্গী, তেজগাঁও, হাজারীবাগ, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর এবং ঘোড়াশাল। এসব এলাকার বেশিরভাগ শিল্প-কারখানার নিজস্ব কোনো শোধনাগার নেই।  টেক্সটাইল শিল্প-কারখানা বছরে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন টন বর্জ্য এবং ০.৫ মিলিয়ন টন সøাজ অপসারণ করে। তুরাগ-টঙ্গী খালের অভ্যন্তরমুখী প্রবাহ কর্ণতলী নদীতে মিলিত হয়ে বুড়িগঙ্গার প্রবাহ হিসেবে পরিচিত। তথ্য মতে, প্রায় ১২ হাজার ঘনমিটার অশোধিত তরল বর্জ্য প্রতিদিন তেজগাঁও এবং বাড্ডা লেক থেকে রাজধানীর জলপ্রবাহে নির্গত হয়। পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বুড়িগঙ্গার পানি প্রবাহে ট্যানারি বর্জ্যই দূষণের প্রধান উৎস। এ ছাড়া কঠিন বর্জ্য বিশেষ করে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের পশম, ধুলা-ময়লা, কাঁচা চামড়ার গাদ প্রতি বছর এলাকার বিভিন্ন স্থানের খোলা ড্রেনে স্তূপ করে রাখা হয়। ইউনাইটেড ন্যাশনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। উল্লেখ করে, হাজারীবাগ চামড়া কারখানা থেকে আগত কঠিন বর্জ্য মধ্যস্থিত বিশাল পরিমাণ তলানি সংগ্রহ করে শহরের বাইরে বিভিন্ন স্থানের নিচু জমিতে ফেলে রাখা হয়, যা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া ট্যানারি শিল্পের ক্রোম বহনকারী কঠিন বর্জ্য থেকে হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমের নির্গমন বাতাসের দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অধিকন্তু ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণে ট্যানারি শিল্প-কারখানার আশপাশের ভূগর্ভস্থ মাটিতে ভারী ধাতুর সন্ধান মেলে যা কখনো সম্পূর্ণরূপে মাটিতে মিলিয়ে যায় না। 

বুড়িগঙ্গার তলদেশে ১০ ফুট গভীরতার পলিথিন জমে থাকার সংবাদ জনমনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করলেও অদ্যাবধি পলিথিন দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বুড়িগঙ্গার যে অংশ লোক বসতির কাছাকাছি সেখানকার তলদেশে উচ্চ গভীরতার পলিথিন জমে থাকায় পানি চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়ে দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণ কোনো বর্জ্য মাটিতে মিশে গেলেও পলিথিনের পলিপ্রোপাইলিন কখনো পচে না। বুড়িগঙ্গার পাড়ে বাবুবাজার, জিঞ্জিরা, কালিগঞ্জ, পোস্তগোলা, শ্যামপুরের অসংখ্য ছোটখাটো কলকারখানা রয়েছে। এসব কারখানা, জাহাজ মেরামত শিল্প, রং ছাপা কারখানা, ধোলাই কারখানা থেকে অশোধিত তরল বর্জ্য প্রতিনিয়ত বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশছে। বিশেষ করে হাসপাতাল বর্জ্য, ব্যবহৃত ব্যাটারির পরিত্যক্ত, পোড়া তেল-মবিল এবং প্লাস্টিক বোতলের মতো বর্জ্য নদীর পানি দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে চলছে। ঢাকা সিটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে, দূষণের মাত্রাও বেড়ে গিয়ে জনস্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে। একসময়ের পানযোগ্য এ পানি আজ নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কাজেই ব্যবহারযোগ্য নয়। 

কালো বর্ণের ঘোলা পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে না পারায় মাছসহ যেকোনো জলজ জীব বা উদ্ভিদের বেঁচে থাকা অসম্ভব। কেননা সূর্যের কিরণবিহীন পানিতে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সংঘটিত হতে পারে না। এমনকি অক্সিজেননির্ভর শ্যাওলাও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, মাছের জীবন রক্ষায় কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ পিপিএম দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রয়োজন পড়ে এবং মাছের জন্য ভালো পরিবেশ দেয় ৯ পিপিএম দ্রবীভূত অক্সিজেন। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৩-এর নিচে নেমে এলে শক্তিধর মাছও মরে যায়। এ ছাড়া কম পরিমাণ বিষাক্ত অ্যামোনিয়ার উপস্থিতিও পানিতে মাছ ও জলজ প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য করে তোলে।

বুড়িগঙ্গায় যারা স্নান করেন তাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগসহ নানা জটিল অসুখ বাসা বাধে। এমনকি বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি পান করে মানুষ ডায়রিয়াসহ নানা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। নদীর পাড়ে বসবাসের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন বুড়িগঙ্গা তীরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। দূষিত পরিবেশের কারণে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠে নিম্নবিত্তের মানুষের আনাগোনা, বাড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। বুড়িগঙ্গার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এর পনির দূষণ রোধ করতে হবে। নদী পাড়ের দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে নদীতে এর নির্গমন বন্ধ করতে হবে। বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মিত বাসগৃহের সিউয়েজ অপসারণের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যাতে তা নিকটস্থ ভূপৃষ্ঠের এবং ভূগর্ভের পানিকে দূষিত করতে না পারে। 

নদীর আশপাশের হাটবাজার থেকে আগত আবর্জনা, কীটনাশক থেকে নদীকে রক্ষা করতে হবে। বুড়িগঙ্গা পাড়ের রাসায়নিক কারখানার তরল বর্জ্যরে সঠিক বিশোধন এবং নিরাপদ অপসারণ ছাড়া নদীর পানির দূষণ রোধ সম্ভব নয়। নদীকে তৈলজাত দূষণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গায় যন্ত্রচালিত নৌযানের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নদীর আশপাশের রাস্তা ও পার্কিং স্থলে ফিল্টার পন্ড নির্মাণ করে তেল ও আবর্জনা মিশ্রিত পানিকে নদীতে নির্গমন রোধ করা যেতে পারে। বুড়িগঙ্গার পাড়ে দৃষ্টিনন্দন গাছপালা লাগিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নদীর পানি দূষণে সহায়তা লাভ করা সম্ভব। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে, নদীর পানিকে নির্মল রাখতে জনগণকে হতে হবে দায়িত্ব সচেতন। 


অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close