ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

ঢালাও মামলায় হয়রানি-গ্রেফতার নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
মামলাবাজিতে সেই পুরোনো চেহারা
প্রকাশ: বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:২০ এএম  (ভিজিট : ৭২৬)
গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে, তা হলো- ‘গঞ্জে (শহরে) যখন আইছি, তাইলে চাচার নামে একটা মামলা দিয়াই যাই।’ বর্তমানে সারা দেশে যেন এমনই এক মামলাবাজি পরিস্থিতি চলছে। রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় মামলা হচ্ছে। গায়েবি মামলা কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আলামত-উপকরণসহ (এভিডেন্স ও মেরিট) প্রাসঙ্গিকতার তোয়াক্কা না করেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে একের পর এক মামলা করা হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে হতাহতের মামলাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে এমন অনেক উদ্দেশ্যমূলক মামলা ও আসামি করা নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে থানা পুলিশের ভূমিকাও ‘সেই আগের মতোই’ প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করছেন অনেকে। 

মানবাধিকার কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারসহ বিগত সরকারগুলোর আমলে যেভাবে পুলিশকে ব্যবহার করে গায়েবি মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হতো, এখনও সেই অভিন্ন চিত্রই দেখা যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যে মূলমন্ত্র বলা হয়েছে, তার সঙ্গে বর্তমানে মামলাবাজির এই পরিস্থিতি যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এখানে শুধু রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা বা দাপটের পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু অপরাজনীতির পরিবর্তন হয়নি। তা ছাড়াও এভাবে ঢালাওভাবে তথ্য-উপাত্তহীন মামলা হলে তাৎক্ষণিক পুলিশকে ব্যবহার করে হয়তো প্রতিপক্ষকে হয়রানি বা শায়েস্তা করা যাবে কিন্তু প্রকৃত ঘটনা আড়ালে ধামাচাপা পড়তে পারে। এমনকি ভুক্তভোগী পরিবার সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রকৃত অপরাধীরাও আইনি ফাঁকফোকরে রেহাই পেয়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখা থেকে সময়ের আলোকে জানানো হয়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে গত ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে হতাহতের ঘটনায় কেবল ঢাকা মহানগরীর থানাগুলোতে ১৯৬টি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নামীয় ও অজ্ঞাতনামা হিসেবে আসামির সংখ্যাও লক্ষাধিক। তবে সারা দেশে এ সংক্রান্ত মোট কতগুলো মামলা হয়েছে সে বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরে যোগাযোগ করা হলেও দায়িত্বশীলরা তাৎক্ষণিক সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেননি। 

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সময়ের আলোকে বলেন, ঢালাও মামলা ও গ্রেফতার গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে শুধু পুরো প্রক্রিয়াকে বিতর্কিতই করবে না, বরং মূল অপরাধীকে পার পেয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দেবে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। আশা করি সরকারের পক্ষ থেকে একদল আইনজ্ঞ নিয়োগ করা দরকার, যারা এ বিষয়ে সহায়তা দিতে পারবে। এটা জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। অতঃপর গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এই আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কয়েকশ। আহত হয়েছেন হাজারও মানুষ। এসব হতাহতের ঘটনায় অনেকস্থানে মামলা হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ মামলার এজাহারে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় ঢালাওভাবে অভিযোগ বা আসামি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হচ্ছে বলেও প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি কিছু মামলায় বাদী নিজেও জানেন না যে কেন তাকে বাদী করা হয়েছে। কোনো রকম তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই না করেই এভাবে মামলা রুজু হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে হতাহতের মামলার বাইরেও ব্যবসায়িক প্রতিহিংসা, রাজনৈতিকভাবে হেনস্থা, এমনকি চাঁদা চেয়ে না পেয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে মামলা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা সময়ের আলোকে বলেন, আইনে আছে যে, কোনো ধর্তব্য অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশ বাধ্য এটার অভিযোগ নিতে। সঙ্গে এটাও বলা আছে ঘটনার মধ্যে সন্দেহ থাকলে সাধারণ ডায়েরি করে অনুসন্ধান করে পরে পুরোদস্তুর মামলা করতে পারে। কিন্তু পুলিশ এটা করে না। কারণ অপজিট পার্টি বলবে আপনি তো ওই পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলা নেননি। আপনি ওদের হয়ে কাজ করছেন। সেই জন্য নিজেকে ‘সেভ’ রাখতে পুলিশ মামলা নেয়।

সাবেক এই আইজিপি বলেন, আবার মামলার আদেশ যদি আদালত থেকে আসে তা হলে সে (পুলিশ) মামলা নিতে বাধ্য। তারপর তদন্ত করে দেখবে। মিথ্যা বা হয়রানির উদ্দশ্যে মামলা করা হলে মামলা দুর্বল হয়ে যাবে। যদি মনে হয় অভিযোগ সঠিক নয়, তখন ঠিক করে দিতে হবে।

গত ৫ আগস্ট সিলেটের সোনারহাট এলাকায় আনন্দ মিছিলে হামলার ঘটনায় গোয়াইনঘাটের মাতুরতল ফেনাই গ্রামের বাসিন্দা আবদুন নুর বিলালের ছেলে সুমন মিয়াকে হত্যার অভিযোগে গত ২৭ আগস্ট আদালতে মামলা করা হয়। অথচ এ মামলার আসামিদের বিষয়ে কিছু জানেন না বাদী আবদুন নুর বিলাল। মামলায় আসামি করা হয় সাবেক বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও পুলিশ সদস্যসহ ১৫০ জনকে। 

এই মামলায় আসামি করা হয়েছে দৈনিক বাংলার সিলেট প্রধান ও ইমজার সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দেবুকে। তার সাংবাদিকতা পেশা গোপন করে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক হিসেবে পরিচয় উল্লেখ করা হয় মামলায়।

মামলাটি হয়রানির জন্য করা হয়েছে উল্লেখ করে সাংবাদিক দেবাশীষ দেবু সময়ের আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল আমার বাসা থেকে অনেক দূরে। ঘটনার দিন তো দূরের কথা আমি গত দুই মাসেও ওই এলাকায় যাইনি। এই মামলার বিষয়ে আমি বাদীকেও জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, তিনি মামলায় আমার নামের বিষয়ে কিছুই জানেন না। শুধু আমি নই, সিলেটে সাংবাদিকসহ অনেক নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার জন্য মামলা দেওয়া হয়েছে। এটা কেউ বা কোনো গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে করাচ্ছে। আর এসব মামলা করাচ্ছে হয়রানি করানোর জন্য-এটা বোঝাই যাচ্ছে।

অন্যদিকে সাহায্য দেওয়ার নাম করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ভবনে গত ৫ আগস্ট আগুন দেওয়া হয় ও ভাঙচুর করা হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনজন। আহত হন অন্তত ৬০ জন। এ ঘটনায় ২০ আগস্ট থানায় একটি মামলা হয়। এতে প্রবাসী, সাংবাদিক, আওয়ামী লীগের ৭৫ নেতাকর্মী ও অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়। 

মামলার বাদী নিহত তারেকের মা ইনারুন নেছা বলেন, সাহায্য দেওয়ার নাম করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে মামলা করা হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন এই নারী। আদালত পুলিশকে তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদক দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এই মামলায় আসামির তালিকায় আছেন স্থানীয় সাংবাদিকও। আবার সিলেটেই রাজনৈতিক মামলায় আসামি করা হয়েছে চ্যানেল আই প্রতিনিধি সাদিকুর রহমান সাকীকে। গত ২২ আগস্ট সিলেটের আদালতে এ মামলা করেন ছাত্রদল কর্মী খোরশেদ আলম। 

তবে স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, খোরশেদ আলম নামে কোনো দলীয় কর্মীকে তারা চেনেন না। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই ময়মনসিংহের ফুলপুরে ধান বিক্রি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন কৃষক সাইফুল ইসলাম। এ ঘটনায় গত ২০ আগস্ট আদালতে মামলা করেন জেলা উত্তর কৃষক দলের সদস্যসচিব শাহ মোহাম্মদ আলী। মামলায় আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীসহ ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। একই মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি নেতা আবদুল খালেক, আলাল উদ্দিন, আবদুল মালেক ও ব্যবসায়ী হাজি সেকান্দর আলীকে। স্বার্থ হাসিল করতে ওই মামলায় বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ীদের নাম যুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর গত ২৫ আগস্ট মামলা প্রত্যাহার করেন তিনি। অন্যদিকে গত ২৭ আগস্ট দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

ঢালাও মামলা ও গ্রেফতারের প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মুখ্য সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট আবু আহমেদ ফয়জুল কবির (ফরিদ) সময়ের আলোকে বলেন, গণমাধ্যমে দেখছি নিরপরাধ অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তি যদি আসামি হিসেবে মামলায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন তা হলে সেটা নিঃসন্দেহে অনাকাংখিত ও একই সঙ্গে অগ্রহণযোগ্য। মামলা নথিভুক্ত করার আগে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার। 

তিনি বলেন, মামলা নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষেরও মন্তব্য দেখছি। আমরা আশা করি সরকার মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন এবং মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সতর্কতা অবলম্বন করবেন। কোনো নিরীহ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সময়ের আলোকে বলেন, প্রকৃত মামলা না হলে সেই মামলার ফল পাওয়া যাবে না। যারা মামলা দিচ্ছেন তারাও চাচ্ছেন মামলা হলো, হয়রানিও হলো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ভিক্টিমের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে না। এটা দুঃখজনক। যারা মিথ্যা মামলা করেছে তাদের তো লাভ আছেই। নাম দিচ্ছেন, হয়রানি করছেন। তাই এ জাতীয় বিষয়ে পুলিশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ও সজাগ ভূমিকা রাখতে হবে।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close