ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

হাসপাতালে বাড়ছে চাপ
ভয়ংকর হয়ে উঠছে ডেঙ্গু
প্রকাশ: বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:০৯ এএম  (ভিজিট : ৩৬৬)
দিন দিন  ভয়ংকর উঠছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। দেশের প্রায় ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বিশেষ করে রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় রোগী ভর্তি হওয়ার চাপ বাড়ছে। রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। শয্যা না পেয়ে অনেকেই মেঝেতেও নিচ্ছেন চিকিৎসা। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুও রেকর্ড। সব মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়াল। আর মৃতদের মধ্যে শূন্য থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে রয়েছে ৪৫ শতাংশ।

মঙ্গলবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৩৪ জন। এর আগের দিন সোমবার একজনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬১৫ জন। যা এ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা। সব মিলিয়ে এ মাসের ১০ দিনে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৯৭৮ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪শ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর আগের মাস আগস্টে মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬ হাজার ৫২১ জন। অথচ গত ১০ দিনেই অর্ধেকের বেশি রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

সেপ্টেম্বরের শেষে এবং সামনের মাসগুলোতে দেশে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরও খারাপের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার কারণে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলররা না থাকায় মশা নিধন কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। নিয়মিতভাবে কাজ করছে না মশক নিধন কর্মীরা। অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম থেমে গেছে। এ ছাড়া লার্ভিসাইড স্প্রে এবং ফগিংসহ সিটি করপোরেশনের নিয়মিত মশাবিরোধী ব্যবস্থাগুলোও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ডেঙ্গুর মৌসুম হওয়ায় রাজধানীসহ সারা দেশে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বিগত কয়েক বছরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে-বর্ষার মূল মৌসুমের পরে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। আর ডেঙ্গু শুধু এখন ঢাকাকেন্দ্রিক নয়, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। সুতরাং ডেঙ্গু প্রতিরোধে কারিগরিভাবে সঠিক ও বাস্তবায়নযোগ্য একটি কর্মকৌশল দ্রুত প্রণয়ন করা জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ১০২ জনের। আর এ বছর মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮১৯ জন। অথচ গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ১৪ জনের। আর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩২৮ জন। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে এ বছর মৃতের সংখ্যা ৭ গুণ বেশি। যদিও আক্রান্তের নয়গুণ কম।

চলতি বছর চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে  ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে ৬৬ জনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। তবে সবচেয়ে বেশি ৫৮ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৭১ শতাংশই মৃত্যুই ঘটেছে ঢাকায়। আর ঢাকার দুই সিটিতে এবার মোট আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৭৬৭ জন। আর আক্রান্তের হার হচ্ছে ৪০ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে বিভাগে ১২ জন এবং বরিশাল বিভাগে ১০ জন। তবে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন চট্টগ্রামে বিভাগে ৩ হাজার ৩০৯ জন। এ ছাড়া চলতি বছরের মৃতদের মধ্যে ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিরা সবচেয়ে বেশি ১১ শতাংশ। এরপরই ১০ শতাংশের বয়স হচ্ছে ৬ থেকে ১০ বছর এবং ২৬ থেকে ৩০ বছর ও ৪৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে রয়েছে ৯ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড। যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১১ জন, যাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিলে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৪ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুজনের। মে মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৪৪ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুন মাসে ৭৯৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে আটজনের, জুলাই মাসে ২ হাজার ৬৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এ ছাড়া আগস্ট মাসে মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬ হাজার ৫২১ জন।

মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ১ হাজার ৬৪২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি ৯১৭ জন এবং ঢাকার বাইরে রয়েছেন ৭২৫ জন। এ ছাড়া চলতি বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৬৬ জন।  আর বর্তমানে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন ১১৬ জন। এরপরই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ১ হাজার ৬৩০ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। আর বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছে ৬২ জন। এ ছাড়া  ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে।

হাসপাতালে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দিন দিন রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর রোগীর চাপ বাড়ছে। এমনকি ঢাকার বাইরে থেকে আসতে শুরু করেছে রোগী, যাদের অধিকাংশই জটিল শারীরিক সমস্যা নিয়ে আসছেন। আবার অনেক রোগী এমন জটিল পর্যায়ে হাসপাতালে আসছেন, যখন আর চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। প্রত্যেকের অবস্থা জটিল হওয়ায় ভর্তি হচ্ছেন এবং ভর্তি হওয়া রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন থাকে না, ব্লাড প্রেশার রেকর্ড করা যায় না।

তারা জানান, জ্বর আসার পর সাধারণ ভেবে ওষুধ খেতে থাকে। চিকিৎসকের কাছেও যায় না। কিন্তু যখন ডেঙ্গু ধরা পড়ে তখন অনেক সময় পেরিয়ে যায়। ফলে হাসপাতালে আসার পরও অনেক রোগী মারা যায়।

এ ব্যাপারে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসিবুল ইসলাম  সময়ের আলোকে বলেন, এ মাসের শুরু থেকে হাসপাতালে রোগীর চাপ কিছুটা বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে হয়তো আরও রোগীর চাপ বাড়তে পারে। তাই রোগী ও স্বজনদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

ডা. হাসিবুল ইসলাম  বলেন, ডেঙ্গু থেকে রক্ষার প্রধান উপায় হচ্ছে নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। শুধু নিজে নয় বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। 

ডা. হাসিবুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে প্রথমে অনেকেই বুঝতে পারে না।  এটাই মূল সমস্যা। সেটি কম জ্বর কিংবা বেশি জ্বরও হতে পারে। কিন্তু জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না। কারণ দেরি করে হাসপাতালে এলে চিকিৎসকদের জন্য সেবা দিতে কঠিন হয়ে পড়ে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্রচণ্ড জ্বর বা হাড়ভাঙা জ্বরসহ পেটে তীব্র ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, প্রচণ্ড দুর্বলতা, বমি অথবা মাড়ি ও নাক থেকে রক্ত আসতে দেখলে তাৎক্ষণিক নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু এমন এক রোগ যে মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত যেকোনো জায়গায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে ডেঙ্গু হলে কোনো ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই।

এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের দেশে একসময় ধারণা করা হতো, বর্ষাকাল মানেই ডেঙ্গুর মৌসুম। কিন্তু এখন সেই ধারণা বদলে যাওয়ার সময় এসেছে। কারণ এখন শুধু বর্ষা নয়, শীত-গ্রীষ্মেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। এর  কারণ হচ্ছে আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, লোকবলের ঘাটতি ও জনসচেতনতার অভাবে উল্টো শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close