ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

একাকিত্বের জালে জর্জরিত জাপান
প্রকাশ: শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:৪০ এএম আপডেট: ০৭.০৯.২০২৪ ৮:০৪ এএম  (ভিজিট : ১৯৯)
একটা সময় পর্যন্ত জাপানিদের সুখ্যাতি ছিল পরস্পর মিলেমিশে বসবাসের জন্য। কাজকর্ম, আড্ডা, মদের আসর সবকিছুতেই তাদের সহজাত প্রবণতা ছিল দল হিসেবে থাকার। একটা সময়ে কোনো জাপানি নাগরিকের একাকী মধ্যাহ্নভোজ সারার দৃশ্য রীতিমতো বিরল ছিল। কেউ একাকী দুপুরের খাবার সেরে নিচ্ছেন নিজের মতো করে, নিভৃতে-এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য। সবার কাছে ব্যাপারটা এতটাই অস্বাভাবিক এবং উদ্ভট লাগত যে কারও যদি একাকী খেতেই ইচ্ছে হতো তা হলে তিনি বাথরুমে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে খেয়ে নিতেন। ভাবা যায় বলুন তো, সঙ্গীহীন থাকাটা এতটাই নিচু চোখে দেখা হয় যে শেষমেশ শৌচাগারে গিয়ে খাবার-দাবারের পাট চুকাতে হতো। 

কিন্তু ধীরে ধীরে এই প্রবণতা বদলে যাচ্ছে। জাপানিদের মাঝে ‘একলা চলো রে’ মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় যে জাতির কাছে একাকিত্ব এতটা নেতিবাচক হিসেবে আবির্ভূত হতো তারাই কি না এখন ‘গো সোলো’ স্লোগানে বিশ্বাসী। একাকিত্বের কালিমা মোচনে কাউকে আর শৌচাগার পর্যন্ত তো যেতে হয়ই না বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সবাই যাতে একাকিত্বের অভিজ্ঞতা নিতে পারেন সেই যজ্ঞই চলছে। রেস্তোরাঁর নকশা বদলে যাচ্ছে, বারে মদ পানে আসর বসানোর বদলে একাকী সুরা পানকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে এবং আরও কত কী। জাপানিদের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় একলা থাকি, একলা চলি, একলা বাঁচি দৃষ্টিভঙ্গির এই জাগরণকে অভিহিত করা হয়েছে ‘ওহিতোরিসামা’ নামে।

দলবদ্ধতা বা পারস্পরিক বন্ধনের সংস্কৃতি থেকে জাপানিদের বেরিয়ে আসার এই চর্চা শুধু খাওয়া আর আড্ডার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। একাকী চলার যে চিন্তাধারা সেটিকে তারা অনেকটা নিজেদের মননে ধারণ করেছেন। অর্থাৎ জীবনযাত্রার সামগ্রিক ধারায় তারা আসলে একাকীই চলতে ইচ্ছুক। বিয়ের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে। আগের তুলনায় মানুষ বর্তমানে অবিবাহিত থাকাতেই আরামদায়ক বোধ করছেন। ২০১৫ সালে ২০ থেকে ৫৯ বছর বয়সিদের মাঝে মাত্র ৫৪ শতাংশ জাপানি বিবাহিত অবস্থায় ছিলেন। বিবাহিতদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাও। চলমান পরিস্থিতিতে প্রতি তিনটি বিবাহিত দম্পতির দাম্পত্যজীবন শেষ অবধি বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।

১৯২০ সালে করা জাপানের প্রথম আদমশুমারির পরবর্তী ৭ দশকে কখনোই অবিবাহিত (পুরুষ এবং নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই) নাগরিকের সংখ্যা ৫ শতাংশের বেশি হয়নি। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জাপানের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিয়ে ছিল একটি সর্বজনীন ঘটনা। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হলে মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে-এটিই ছিল চল বা অন্যভাবে বললে অবিবাহিত থাকার ঘটনা ছিল একেবারেই বিরল। ১৯৯০ সালের পর থেকে এই চিত্রটি বদলে যেতে শুরু করে। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত আদমশুমারিতে দেখা গেল যে ২৩.৪ শতাংশ পুরুষ এবং ১৪.১ শতাংশ নারী অবিবাহিত।

ধারণা করা যাচ্ছে যে ২০৪০ সাল নাগাদ প্রতি তিনজন পুরুষের মাঝে একজন এবং প্রতি পাঁচজন নারীতে একজন তাদের জীবনের পুরোটা অবিবাহিত অবস্থায় রয়ে যাবেন। এই অবস্থার দিকে জাপান যে সত্যিই এগোচ্ছে তার একটা প্রমাণ হতে পারে প্রতি বছরে বিবাহের সংখ্যা। ১৯৭৩ সালে মোট বিবাহের সংখ্যা ছিল ১.১ মিলিয়ন (১১ লাখ) যেটি ২০১৮ সালে কমে হয়েছে ৫ লাখ ৯০ হাজার। 

একাকিত্বের জালে জর্জরিত জাপান। দিন দিন বাড়ছে নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা। ফলে অনেক সময় মারা যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন তা জানতে পারছে না স্বজন বা প্রশাসন। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই একাকিত্বের কারণে বাড়িতেই মৃত্যু হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের। এর মধ্যে অন্তত ৪ হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, তাদের মৃত্যুর এক মাসেরও বেশি সময় পর। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো-১৩০ জনের মতো মানুষকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, যারা এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন। জাপানের ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সির তথ্যমতে, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে ৩৭ হাজার ২২৭ জনকে একাকী বাড়িতেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষ বসবাস করেন জাপানে। বিভিন্ন কারণে তাদের অধিকাংশই নিজ বাড়িতে একাকী থাকতে বাধ্য হন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ জাপানে একাকী বসবাসকারী বয়স্ক (৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সি) নাগরিকের সংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যা, যৌথ পরিবারের সংখ্যা হ্রাস, কর্মব্যস্ত জীবনযাত্রা ইত্যাদি কারণে জাপানের এক বড় অংশই এখন একাকিত্বের ভয়াবহ বাস্তবতার সম্মুখীন। বিষয়টি জাপান সরকারের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

জাপানের রাজধানী টোকিওর নারীদের গ্রামাঞ্চলে পুরুষদের সঙ্গে বিয়ের প্রলোভনে নগদ অর্থ ও বিয়ের আয়োজনে যাতায়াতের ট্রেনের টিকেট দেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছে জাপান সরকার। ব্যাপক সমালোচনার মুখে শুক্রবার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে টোকিওর বাইরে বিবাহ ও বসবাস শুরু করা নারীদের জন্য ৬,০০,০০০ ইয়েন (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫,১৭,০০০ টাকা) পর্যন্ত অর্থ প্রদানের পরিকল্পনা করেছিলেন কর্মকর্তারা। কিন্তু পরিকল্পনাটি প্রকাশের পরপরই তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সমালোচকরা এটিকে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক এবং অপমানজনক আখ্যা দেন।

সমালোচনার মুখে আঞ্চলিক পুনরুজ্জীবনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হানাকো জিমি শুক্রবার জানান, তিনি কর্মকর্তাদের পরিকল্পনাটি পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে অর্থপ্রদানের পরিমাণ সম্পর্কে প্রকাশিত খবর সত্য নয়। এক্স-এ একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘তারা কি ভেবেছে যে শহুরে স্বাধীন, উচ্চাকাক্সক্ষী এবং শিক্ষিত নারীরা ভাববেন, ‘কী বলছ। 

আমি যদি একজন স্থানীয় পুরুষকে বিয়ে করে গ্রামে চলে যাই, তা হলে ৬,০০,০০০ ইয়েন পাব। আমি অবশ্যই যাব।’ ... তারা কি সত্যিই এটা ভেবেছে?’ আরেকজন লিখেছেন, ‘তারা কি এখনও বোঝে না? যারা মনে করে নারীরা শুধু সন্তান জন্ম দিলেই মূল্যবান, তারাই কেবল এই ধরনের কিছু ভাবতে পারে।’

উল্লেখ্য, বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপানে বার্ধক্যজনিত কারণে অনেক গ্রামাঞ্চল জনসংখ্যা হ্রাসের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। কিছু ছোট শহরে খুব কম বা একেবারেই শিশু নেই। এর অন্যতম কারণ, গ্রাম ও ছোট শহর থেকে উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ভালো সুযোগের আশায় তরুণীদের তুলনায় তরুণ পুরুষ বেশি বেরিয়ে আসে, বিশেষ করে টোকিওতে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close