চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণা সহকারী ও শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত শিক্ষক মো. ইসলাম মিয়া। তিনি চুয়েটের পেট্রোলিয়াম এন্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং (পিএমই) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের উপ-পরিচালক।
গত সোমবার ঐ শিক্ষকের পদত্যাগকে প্রধান দাবি করে আরও ১০দফা দাবি নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয় একই বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
উক্ত আন্দোলনে যুক্ত পিএমই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আলিফ হোসেন জানান, মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া বিভিন্ন অনৈতিক ও দুর্নীতিমূলক কাজের সাথে যুক্ত। তিনি গবেষণা সহকারীদের বেতনের অর্থ, সোসাইটি অব পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার্স (এসপিই) এর তহবিলের টাকা আত্মসাৎ ও বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে হয়রানি করেছেন। এছাড়াও তিনি ক্লাসে অন্যান্য শিক্ষকদের সমালোচনা ও তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উস্কানি দিতেন এবং ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের মদদ দিতেন। তাই এমন কুরুচিপূর্ণ ও বিকৃত মানসিকতার একজন ব্যক্তিকে আমরা শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে পারিনা। আমরা চুয়েট প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, অতিদ্রুত যেন তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব না।
এদিকে গতকাল (বুধবার) সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে চুয়েট সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গ্রুপ “রিফর্ম চুয়েট”- এ ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়া এবং গবেষণা সহকারীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে পোস্ট করেন ঐ বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাভিদ ইউসুফ। তিনি তার পোস্টে মো. ইসলাম মিয়ার গবেষণা সহকারী পিএমই বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাগর হোসেন সবুজ ও আলমগীর পাঠানের বেতনের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে ইসলাম স্যার ২০২২ সালের ৩০ জুন একটি প্রজেক্টে (Project ID: CUET/DRE/2021-2022/PME/002) গবেষণা সহকারী হিসেবে এক বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। একটি প্রজেক্টে পূর্ণ মেয়াদে আমি সহকারী হিসেবে থাকা স্বত্বেও তিনি আমাকে ২০২২ সালের জুলাই মাসে গবেষণা সহকারী হিসেবে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) আরেকটি গবেষণা প্রজেক্টে (Project ID: MHD20221870) এক বছরের জন্য নিয়োগ দেন। উক্ত প্রজেক্টে গবেষণা সহকারীর মাসিক বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা। আমাকে নিয়োগ দেয়ার পরে উনি আমাকে এ প্রজেক্টের কোনো কাজই করাননি। প্রজেক্ট শুরুর ৬ মাস পর তিনি একদিন আমার নামে ইস্যুকৃত আমার বেতন বাবদ ৯০ হাজার টাকার একটি চেক দিয়ে টাকা তুলে আনতে বলেন। টাকা তুলে নিয়ে আসলে সেই টাকার পুরোটা তিনি নিয়ে নেন। এর আরও ৬ মাস পর তিনি একইভাবে আমার নামে ইস্যুকৃত আরও একটি চেকের মাধ্যমে আরও ৯০ হাজার টাকা তুলে নিয়ে উনি আত্মসাৎ করেন। এরপর উনি আমাকে উনার অফিসে একটি কাগজে টাকা প্রাপ্তি স্বীকার মর্মে আমার স্বাক্ষর নেন। প্রকৃতপক্ষে উনার উদ্দেশ্য ছিল গবেষণা প্রকল্পে সহকারী নিয়োগ দিয়ে আমাকে কোন কাজ না করিয়ে পুরো টাকা আত্মসাৎ করা।
অভিযুক্ত শিক্ষক মো. ইসলাম মিয়া সোসাইটি অব পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার্স (এসপিই) বাংলাদেশ সেকশনের সাধারণ সম্পাদক। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন এসপিই চুয়েট স্টুডেন্ট চ্যাপ্টারের সদস্যরা।
এ বিষয়ে এসপিই বাংলাদেশ সেকশনের কোষাধ্যক্ষ মো. তৌহিদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, এসপিই বাংলাদেশ সেকশন (প্রফেশনাল) এর পক্ষ থেকে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চুয়েট স্টুডেন্ট চ্যাপ্টারকে ৩০ হাজার টাকার চেক প্রদান করা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সভা-সেমিনার আয়োজনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে এই অর্থ ব্যয় করা। চেকটি সংগঠনের নিয়ম অনুযায়ী গ্রহণ করেন স্টুডেন্ট চ্যাপ্টারের ছাত্র প্রতিনিধি মোহাইমিনুল ইসলাম। তার সাথে তখন ছিলেন ড. মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া। পরবর্তীতে চুয়েট চ্যাপ্টারের কয়েকজন সদস্য আমার সাথে যোগাযোগ করে জানান, অর্থের অভাবে তারা কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারছেন না। আমি তখন চেক গ্রহণকারী সেই ছাত্র প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি তার হাতে প্রদান করা চেকটি ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে সোনালী ব্যাংক চুয়েট শাখায় ভাঙ্গিয়ে সম্পূর্ণ টাকা ড. মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া নিয়ে নেন। পরবর্তীতে উনার কাছে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য টাকা চাইলে তিনি ফান্ডে কোনো টাকা নেই বলে জানান এবং তাদেরকে নিজেদের টাকায় অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বলেন।
ঐ ছাত্র প্রতিনিধি পিএমই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুহাইমিনুল ইসলাম বলেন, ঢাকার গুলশানে শেভরন এর অফিসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে চুয়েটসহ বাংলাদেশের ৬টি স্টুডেন্ট চ্যাপ্টার এর ছাত্র প্রতিনিধিদের প্রত্যেকের হাতে ৩০ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়। সেই চেক আমি বহন করে চুয়েটে নিয়ে আসি। পরে পিএমই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান নুর আবির স্যারের মাধ্যমে আমি ইসলাম স্যারের কাছে চেকটি হস্তান্তর করি। পরবর্তীতে চুয়েট চ্যাপ্টারের ১৯ ব্যাচের ভাইরা অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য স্যার থেকে কোন টাকা পাননি বলে আমাদের জানান।
পিএমই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সানাউল রাব্বি পাভেল বলেন, শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি আমাদের কাছে লিখিত আকারে দিয়েছে। আমরা এ নিয়ে বিভাগে তিনবার সভা করেছি। আশা করছি খুব দ্রুতই গুরুত্ব সহকারে এ বিষয়গুলো সমাধান করা হবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি নিয়ে এসেছিল। মো. ইসলাম মিয়ার পদত্যাগের দাবি যেহেতু দাবিগুলো পিএমই বিভাগ সংশ্লিষ্ট। তাই দাবিগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে আমি বিভাগীয় প্রধান ও অনুষদের ডিনকে বলেছি। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে উনারা সিদ্ধান্ত নিবেন।
অপরদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া বলেন, চুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ভালো সম্পর্ক আগেও ছিলো এখনও আছে। হতে পারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। পরবর্তীতে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আলোচনা করে বিষয়টি সমাধান করবো।
উল্লেখ্য, গত সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় পিএমই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির এবং যন্ত্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক কাজী আফজারুল রহমান এর উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলিং কক্ষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সভা আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিসমূহ তুলে ধরেন।
সময়ের আলো/আরআই