ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্য পানি ওষুধের সংকট
মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা
প্রকাশ: রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১০:৫৪ পিএম  (ভিজিট : ৫৪২)
কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও এখনও বন্যার পানি কোমরের ওপরে। ফেনীর তুলনামূলক নিচু ভূমির এলাকায় লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। তার মাঝেই এখন বড় সংকট হয়ে দেখা দিচ্ছে- খাদ্য, পানি ও ওষুধের। স্থানীয়রা মনে করছেন, এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে বন্যাকবলিত এসব এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। রোববার সরেজমিন ফেনীর বিভিন্ন বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরে ও বন্যার্ত স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারিভাবে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও পৌঁছেনি দুর্গম সীমান্তবর্তী এলাকায়। ওইসব এলাকায় এখনও সাধারণ মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এরই মধ্যে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ বেড়েছে। বর্তমানে পরিবেশ অনুকূলে থাকলেও ভারত থেকে আসা পানি নামছে ধীরে ধীরে। পানি কমতে শুরু করায় সম্মুখে আসছে ভয়াবহ ক্ষতের চিহ্ন। প্রথমদিকে বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার মানুষজন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তীতে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলা আক্রান্ত হয়। এতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছে।

রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন দেখা গেছে, ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার পানি অনেকটা নেমে যেতে শুরু করেছে। বন্যা-পরবর্তী ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন স্থানীয়রা। বন্যার কারণে জেলার অধিকাংশ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে যাতায়াত ব্যবস্থায় অনেকটা ভেঙে পড়েছে। তবে দাগনভূঞার পূর্বচন্দ্রপূর, সিন্দরপুর ও রাজারপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম এখনও বন্যার পানিতে ডুবে আছে। সম্প্রতি ভারতীয় উজানের পানি ও টানা বর্ষণের ফলে পুরো ফেনী জেলা প্রায় ডুবে যায়।

স্থানীয়রা জানান, ঢাকা থেকে যারা ফেনীর বন্যাকবলিতদের জন্য ত্রাণ দিতে যাচ্ছেন তারা সম্মুখভাগে যাদের পাচ্ছেন তাদের ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তেমন ত্রাণের দেখা নেই বলে অভিযোগ করেন শাহাদাত নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। 

তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনী আমাদের হেলিকপ্টারে করে ত্রাণ দিয়েছে এবং দিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু এগুলো অনেক সময় খাওয়ার উপযোগী থাকছে না। কারণ, পানিতে ওই ত্রাণের প্যাকেট পড়ে গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

দাগনভূইয়া উপজেলার ওমরাহবাদ গ্রামের অটোরিকশা চালক মুমিনুল সময়ের আলোকে বলেন, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ৮ লাখ টাকা মাছের ঘেরে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। বন্যার কারণে মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে সব মাছ বের হয়ে গেছে। 

তিনি আরও বলেন, নিজের কিছু জমানো টাকা ছিল আর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মাছের ঘের দিয়েছিলাম। একটু সাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘের পরিচালনা শুরু করলেও স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় আমার সব আশা, সব স্বপ্ন ধুয়ে-মুছে দিয়েছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, একে তো ঋণের বোঝা অন্যদিকে বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কীভাবে দিন কাটবে এ কথা ভাবতেই পারছি না।

মুমিনুলের মতো একই অবস্থা নার্সারি ব্যবসায়ী আবদুর রহমানের। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে নার্সারি ব্যবসা শুরু করলেও বিক্রির আগেই সব তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। ঋণের কিস্তি এখন পরিশোধ করবেন কীভাবে সেই চিন্তা নিয়ে দিন পার করছে। তিনি বলেন, ঋণের বোঝা নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন। এর চেয়ে বন্যায় মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিল। তিনিসহ পরিবারের সবার মধ্যে নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। মরে গেলে ঋণের বোঝা নিয়ে তো আর চিন্তা করতে হতো না।

দাগনভূঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপূর ইউনিয়নের বায়তুল নুর মসজিদের ছাদে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মওলানা জাকির হোসেন। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, একসময় নিজের বাড়িতে অনেক অসহায় এতিমকে খাওয়ালেও আজ আমার নিজেরই থাকার জায়গা নেই। পরিবারকে বাঁচাতে আশ্রয় নিতে হয়েছে মসজিদের ছাদে। রাতের আঁধারে হঠাৎ করে প্লাবিত শুরু হওয়ায় বাড়ি থেকে কিছুই বের করতে পারিনি। এখনও বাড়ির ভেতরে হাঁটু পরিমাণ পানি। জানি না আল্লাহ কবে নাগাদ এই আজাব থেকে মুক্তি দেবেন।

এদিকে বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার জন্য ফেনীর মুহুরী রেগুলেটরের ৪০টি স্লুইস গেট ও নোয়াখালীর মুছাপুরের ১৭টি স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বন্যার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। উপজেলা ও ফেনী সদরে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ লক্ষ্য করা গেছে। এ মুহূর্তে ফেনীতে সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্য, পানি ও ওষুধের। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে গুরুতর মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতেও পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

এ ছাড়া বন্যার কারণে গত কয়েক দিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক গতি ফিরে পাচ্ছে। বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস, ডুবুরি দল ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী টিম ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকায় ডেঙ্গি নৌকা ও স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে। পাশাপাশি ত্রাণসামগ্রী বিতরণেও সহায়তা করে যাচ্ছেন তারা।

কুমিল্লা লাকসাম থেকে ফেনীর পরশুরামে মেয়েকে দেখতে যাওয়া আনিসুর রহমান সময়ের আলোকে জানান, বন্যায় আক্রান্ত মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফেনীর মহিপাল থেকে ফুলগাজী পরশুরাম সড়ক দিয়ে কোমর পরিমাণ পানিতে হেঁটে হেঁটে চলে যান। তবে এক দিন থেকে ফিরে আসার সময় অধিকাংশ স্থানে পানি তেমন নেই বলে জানান।

ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, জেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে আরও পানি কমে যাবে।

সরকারি হিসাবে ফেনী জেলায় এ পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন। তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধারণা স্থানীয়দের। অন্যান্য উপজেলার তুলনায় দাগনভূঞা উপজেলা নিম্নাঞ্চলের দিকে হওয়ায় এ উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় এখনও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরের ওপর রয়েছে বন্যার পানি।

ফেনী জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বর্তমানে ১৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৬ হাজার ৯৮ জন আশ্রিত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও অনেকে উঁচু ভবন ও ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যাকবলিতদের জরুরি চিকিৎসায় সরকারিভাবে জেলায় ২৮ মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। যার মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে ৭টি মেডিকেল ক্যাম্প চালু রয়েছে।

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close