ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

কুড়িগ্রাম উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য
টাকা ছাড়া মেলে না উপবৃত্তির অর্থ
প্রকাশ: রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২:০৮ এএম আপডেট: ০১.০৯.২০২৪ ৮:০৪ এএম  (ভিজিট : ২৫৯)
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থানকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। টাকা ছাড়া মেলে না শিক্ষা উপবৃত্তি। অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরদের উপবৃত্তির টাকা নয়ছয়ের অভিযোগও তুলেছেন তারা। শুধু তাই নয়, এসব অনিয়মের খবর যাতে বাইরে প্রকাশ না হয় সে জন্য ইউনিয়ন সমাজকর্মীদের দেওয়া হয় না ট্যাবের পাসওয়ার্ড। অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ভিক্ষুক পুনর্বাসন তালিকা নিয়েও।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, আমি ইতিমধ্যে সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় পরিদর্শন করেছি। বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এরপর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

এদিকে সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এসএম হাবিবুর রহমান শিক্ষা উপবৃত্তি না পাওয়ার দায় চাপিয়েছেন সুবিধাভোগীদের ওপর। তার কথায়, তারা প্রতিবন্ধী ভাতা নিতে ইচ্ছুক। তারা প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি নিতে চান না। কারণ এটা সাময়িক। ইউনিয়ন সমাজকর্মীদের ট্যাবের পাসওয়ার্ড না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পাসওয়ার্ডের জটিলতা রয়েছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, অনেক স্টাফ আছে যাদের বয়স হয়েছে। এই বিষয়ে তারা কোনো প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় ট্যাবের পাসওয়ার্ড দেওয়া হয় না।

যাত্রাপুর ইউনিয়ন সমাজকর্মী শাহিনুর বেগম বলেন, সরকারিভাবে আমরা একটি করে ট্যাব পেয়েছি। কিন্তু সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা পাসওয়ার্ড না দেওয়ায় এখন সেগুলো সন্তানদের খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাসওয়ার্ড না থাকায় সদর উপজেলার ইউনিয়ন সমাজকর্মীদের কেউই সেগুলো ব্যবহার করতে পারছেন না।

কাঁঠালবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রেদওয়ানুল হক দুলাল বলেন, সমাজসেবা কল্যাণ পরিষদ, সিএসপি প্রজেক্ট, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা উপবৃত্তির সুবিধাভোগীদের তালিকা সম্পর্কে আমি জানি না। কীভাবে সমাজসেবা অধিদফতর বাস্তবায়ন করছে তা তারাই ভালো জানে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে উপবৃত্তি পাচ্ছেন ৯২ জন এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন ৪৪ জন। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তির প্রাথমিক স্তরে ৯০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৯৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ১০০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১২০০ টাকা করে প্রদান করে আসছে সরকার।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছেন কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী। একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন ধরে কাজের সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশদের সঙ্গে নিয়ে তারা গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। এই সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সদর উপজেলার প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তিসহ অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির তালিকা। সিন্ডিকেট চক্রকে সন্তুষ্ট না করতে পারলে তালিকায় নাম ওঠে না। আবার তালিকায় নাম থাকার পরও সিন্ডিকেট চক্রকে উৎকোচ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারলে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের দুবাআছরি গ্রামের একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া মনিকা বালা ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী গোলাপি রানী। অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষা উপবৃত্তির তালিকায় উপকারভোগী হিসেবে নাম রয়েছে মনিকা বালার। সেখানে অভিভাবকের নাম, গ্রামের নামসহ সব ঠিক থাকলেও ঠিক নেই শুধু মোবাইল নম্বরটি। সেখানে দেওয়া হয়েছে অন্য একটি নম্বর। টাকা যাচ্ছে সেই নম্বরে। একই অবস্থা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া গোলাপিরও। এরকম আরও অনেক উপকারভোগীর নাম তালিকায় থাকার পরও টাকা পাচ্ছেন না তারা। অন্যদিকে তালিকায় নাম নেই অথচ নিয়মিত টাকা পাচ্ছেন অনেকেই। আবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অনেকেই বেশ কয়েকবার টাকা পেলেও হঠাৎ করেই টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেছে।

মনিকা বালা বলেন, আমি তো আবেদনই করি নাই। অথচ অনগ্রসর শিক্ষা উপবৃত্তির তালিকায় আমার নাম, বাবা-মায়ের নামসহ সব তথ্যই ঠিক আছে। শুধু যে মোবাইল নম্বরে টাকা যায় সেটা আমার নয়। আমি এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ছি। বিগত দশ বছরে আমি এক টাকাও উপবৃত্তি পাইনি। গোলাপি রানীর মা শেফালি রানী বলেন, তালিকায় যে নাম-ঠিকানা আছে তার সবই মিল আছে। কিন্তু যে মোবাইল নম্বরে উপবৃত্তির টাকা যায় তা আমাদের নয়। আমার মেয়ে কোনো উপবৃত্তির টাকা পায় না। একই অবস্থা সঞ্জয় কুমারেরও। সঞ্জয়ের বাবা নিপু চন্দ্র বলেন, আমার ছেলে প্রায় তিন বছর ধরে কোনো টাকা পাচ্ছে না। তালিকায় আমাদের নাম-ঠিকানাসহ সব ঠিক থাকলেও অন্য নম্বরে টাকা দিচ্ছে। কীভাবে তালিকায় নাম না থাকার পরও টাকা পাচ্ছে সেটা আমরা বলতে পারব না। অফিসের কারসাজির জন্য আমরা গরিব মানুষ সরকারের এমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

অনুকূল চন্দ্র সেনের মা শ্রীমতি রত্না রানী বলেন, তালিকায় আমার ছেলের নাম রয়েছে। আগে টাকা পেয়েছি। কিন্তু দুই বছর ধরে টাকা পাই না। অফিসে গিয়েও কাজ হয়নি। আমাদের মোবাইল নম্বরের পরিবর্তে টাকা যাচ্ছে আরেকটি নম্বরে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমাদের পাশের গ্রাম গড়ের পাড়ের একজন সেই টাকা পাচ্ছেন। অথচ তালিকায় তার নাম নেই।

এ বিষয়ে গড়ের পাড় গ্রামের বাসিন্দা শাহানাজ বেগম বলেন, অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির তালিকায় আমার সন্তানের নাম নেই। কিন্তু ঘোগাদহ ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার শংকরকে দুই সন্তানের জন্য কয়েক দফায় প্রায় ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর থেকে এক সন্তানের জন্য উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছি। একই এলাকার মালতি রানী বলেন, আমরা তো অফিসের ব্যাপার বুঝি না। তাই সাবেক মেম্বার শংকরকে তিন হাজার টাকা দিয়ে সন্তানের জন্য উপবৃত্তির টাকা নিচ্ছি। সে কীভাবে করে দিয়েছে সেই ভালো বলতে পারবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত সাবেক শংকর মেম্বার টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, অফিস খরচের জন্য কিছু টাকা নেওয়া হয়েছে। তবে উপবৃত্তির তালিকা থেকে মোবাইল নম্বর পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

শুধু শিক্ষা উপবৃত্তিতে নয়, অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ভিক্ষুক পুনর্বাসন তালিকা নিয়েও। ভিক্ষুক নয় এমন পরিবারকে ভিক্ষুক দেখিয়ে নামমাত্র সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সেখানেও শুভংকরের ফাঁকি। ঘোগাদহ ইউনিয়নের গরিব অসহায় একটি পরিবারের জন্য ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও দেওয়া হয়েছে দুটি ছাগল এবং একটি ঘরসহ নগদ দুই হাজার টাকা। সুবিধাভোগী আফরোজা বেগম বলেন, আমার স্বামী ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে কিছু দিন আগে মারা গেছে। তার চিকিৎসার পেছনে জমিজমা সব শেষ। তবে আমরা ভিক্ষুক নই। জুন মাসে সমাজসেবা অফিস থেকে দুটি ছাগলের বাচ্চা এবং একটি ছোট ঘর দিয়েছে। আর দিয়েছে নগদ দুই হাজার টাকা। আমরা ২৫ হাজার টাকা পাইনি।




সময়ের আলো/আরএস/







https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close