ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

বেকার ৩৫ হাজার শ্রমিক
এক যুগে বন্ধ ৮০ ভাগ চালকল
প্রকাশ: রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪, ৪:২২ এএম  (ভিজিট : ২৮০)
উত্তরের ‘শস্যভান্ডার’ খ্যাত নওগাঁ জেলায় ক্রমাগত লোকসান ও অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে গত এক যুগে প্রায় ৮০ ভাগ চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। ধারদেনা পরিশোধের জন্য অনেক ব্যবসায়ী চালকল বিক্রি করে বিকল্প ব্যবসায় ঝুঁকছেন। এদিকে একের পর এক চালকল বন্ধ হওয়ায় অর্ধ লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিকই বেকার হয়ে পড়েছেন।

জেলা চালকল মালিকদের দাবি, সরকারি নীতিমালা না থাকায় করপোরেট ব্যবসায়ী ও বড় বড় চালকল মালিকদের ইচ্ছেমতো বাজার সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির চালকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বড় চালকল (অটোমেটিক) মালিকরা বলছেন, তাদের কারণে নয় বরং দেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেট কোম্পানিগুলোর বাজার সিন্ডিকেটের কারণে শুধু হাসকিং মিলই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, বরং অটোমেটিক রাইস মিলের অবস্থাও ভালো নয়।

ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ধান উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি, সংকট পুঁজি করে অনৈতিক মুনাফার আশায় করপোরেট ব্যবসায়ীদের খোলাবাজার থেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ধান-চাল কেনা এবং মজুদ করে বাজার সিন্ডিকেট, প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ টাকা অনাদায়, সরকার নির্ধারিত ধান-চালের মূল্যে সমন্বয়হীনতা, বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে চালের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, ২৫ শতাংশ শুল্কভার নিয়ে চাল আমদানিতে বেসরকারি খাতের নিরুৎসাহিত মনোভাব এবং ব্যাংকের চড়া সুদের কারণে শিল্পটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

জেলা চালকল মালিকদের তথ্য অনুযায়ী নওগাঁয় ধান প্রক্রিয়াজাতে আশির দশকে গড়ে ওঠে প্রায় ২ হাজার হাসকিং চালকল। কালের বিবর্তনে টিকে আছে মাত্র ৩১৫টি। বাকিগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা টিকে আছে তারা আবার ঋণে জর্জরিত। অন্যদিকে ১০-১২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ৭৯টি অটো রাইস মিলের মধ্যে ১১টি বন্ধ হয়ে গেছে এবং ৪৪টির বেহাল দশা। এসব চালকলের মালিকদের মধ্যে কেউ দেউলিয়া, কেউ ঋণগ্রস্ত, কেউ জেলহাজতে আবার কেউ ফেরারি আসামি। ফলে একটা সময়ে শ্রমিকদের ব্যস্ততায় মুখর থাকা চালকলগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা। সেগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ছেয়ে গেছে আগাছায়। আবার বন্ধ হওয়া অনেক চালকল আর চাতালে গড়ে উঠেছে প্লাস্টিক কারখানা, হাঁস-মুরগি এবং গরু-ছাগলের খামার।

সরেজমিন নওগাঁর পিরোজপুরে মামনি অটো রাইস মিলে দেখা যায়, এটি বন্ধ হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগে। একই অবস্থা বাইপাস এলাকার জাহানারা অটো রাইস মিলের। শহরের বরুণকান্দি এলাকার রুস্তম অটোমেটিক রাইস মিল এখন অস্তিত্বহীন। সদর উপজেলার হাপানিয়া এলাকার দিশা অটোমেটিক রাইস মিলের গোডাউন ব্যতীত মেশিনপত্রসহ সবকিছু বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে মহাদেবপুরের ছামী অটোমেটিক রাইস মিল। ঋণের জন্য আদালতে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন মহাদেবপুরের কফিল উদ্দিন রাইস মিল, বিসমিল্লাহ অটো রাইস মিল ও করিম অটো রাইস মিলের মালিকরা। অস্তিত্ব নেই পিরোজপুরের মিরজান অটো রাইস মিল, যুব উন্নয়ন এলাকার নাহার অটো রাইস মিল ও সুলতানপুরের শাহা অটো রাইস মিলের। শহরের চকবাড়িয়া এলাকার নর্থবেঙ্গল অটো রাইস মিলের জায়গা এখন প্লট আকারে বিক্রি হচ্ছে।

মহাদেবপুরের রাসেল চালকলের সাবেক মালিক মোজাহার আলী বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে চাতালের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তিন বছর আগে চালকল বিক্রি করে দিয়েছি। আমার পাশর্^বর্তী চালকলগুলোতে চাল উৎপাদনের পরিবর্তে এখন ধানের চিটা সংগ্রহ করে গুঁড়া ভাঙানোর কাজ হচ্ছে। কেউ আবার ব্রয়লার মুরগি পালন করছেন। আমার মনে হয়, হাসকিং মিলগুলো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। নওগাঁ সদরের ফারিহা রাইস মিলের মালিক ফরিদ উদ্দিন বলেন, অটো রাইস মিলে ২৪ ঘণ্টায় ১০ জন শ্রমিক ৩০ টন চাল উৎপাদন করতে পারে। আর হাসকিং মিলে এক সপ্তাহে ৩০ টন চাল উৎপাদন করতে পারে ১৫ জন শ্রমিক। আগে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অটো রাইস মিল আসার পর শ্রমিকরা বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।

জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, আগে হাসকিং চালকলগুলো লাভজনক ছিল। কিন্তু ব্যবসায় ধস ও ব্যাংকের উচ্চ সুদহারের কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। 

নীতিমালা না থাকা, অপ্রয়োজনীয় আমদানি, করপোরেট ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত চালকল ও অনাদায়ী টাকা ফেরত না দেওয়ার কারণে চালকলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চালকল রক্ষায় সরকারের নীতিমালা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। প্রতিটি রাইস মিলের জন্য একজন মিলারকে প্রতি বছর ১৪ রকমের লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন করতে হয়। এসব করতে বৈধ ও অবৈধ ফিসহ দুই টাকা খরচ করতে হয়। সঙ্গে পোহাতে হয় চরম বিড়ম্বনা।

নওগাঁ অটো রাইস মিল সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, মাত্র ৩-৪ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা নিয়ে বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো বাজারে এসে বড় লটে বাজার থেকে ধান-চাল কিনছে। তারা ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যদিকে আমাদের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম ১৩ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে। ফলে মাত্র ৩-৪ শতাংশ সুদে পরিচালিত করপোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা টিকতে পারছে না। 

তাদেরও বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলোর মতো স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া দরকার। সরকার একদিকে কৃষককে ধানের দাম বেশি দিতে চায় যা নির্ধারিত নয়। কিন্তু চালের দাম দিতে চায় নির্ধারিত। এতে চাল ও ধানের মূল্যের সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। ধান উৎপাদনে ঘাটতি আছে। তবে ঘাটতির পরিমাণ সরকার স্পষ্ট করছে না। নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের ধারণা, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দেশে ধান উৎপাদনে ঘাটতি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন।

নওগাঁ জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর রহমান বলেন, জেলায় সরকারের সঙ্গে চুক্তিভুক্ত সচল হাসকিং চালকলের সংখ্যা ৩১৫টি। চুক্তিভুক্ত সচল অটো রাইস মিলের সংখ্যা ৭৯টি। এর মধ্যে সেদ্ধ অটো রাইস মিল ৫০টি ও আতব অটো রাইস মিল ২৯টি। আগে সরকারি গুদামে ৮৮৩টি চালকল চুক্তিবদ্ধ ছিল। এর মধ্যে অটো রাইস মিল ছিল ৫১টি ও হাসকিং মিল ছিল ৮৩২টি। অটো রাইস মিলের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, শ্রমিক সংকট ও সরুচালের প্রতি মানুষের আকর্ষণই এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও চালকল মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে বছরে প্রায় ১৭ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। প্রতিদিন উৎপাদন হয় প্রায় ৪ হাজার ৬০০ টন চাল। ৫৫ হাজার টাকা টন হিসেবে যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

শ্রমিক নেতা মোজাফফর হোসেন বলেন, শ্রমিকদের মজুরি কম কিন্তু কাজ বেশি। মজুরি কম হওয়ায় শ্রমিকরা এখন ভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছে। একজন শ্রমিককে ১০ বছর আগে যে মজুরি দেওয়া হতো এখনও সেই মজুরি দেওয়া হচ্ছে। মজুরি বাড়াতে মালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। কিন্তু আমরা অবহেলিত ছিলাম, অবহেলিতই আছি।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close