ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

কেমন ভিসি চাই
প্রকাশ: রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪, ২:১৫ এএম  (ভিজিট : ১৪৯৪)
দেশের স্বাধিকার অধিকার সম্মান নিরাপত্তা এবং বাক-স্বাধীনতার স্বাদ ফেরাতে ছাত্রসমাজ অকুতোভয় কান্ডারি হিসেবে জাতির ডুবন্ত জাহাজে নাবিকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। শহিদ সাঈদ-মুগ্ধসহ অসংখ্য তাজা প্রাণের রক্তে সবুজ চত্বর আজ প্লাবিত। 

বাতাসে মরদেহের গন্ধ। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর পেটোয়া বাহিনীর দাম্ভিক স্বীকারোক্তি-‘গুলি করি মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার! বাকিডি যায় না, এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের!’ এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ছাত্রসমাজ পিছু হটেনি। ফলশ্রুতিতে জনতা স্বাধীনতা পেয়েছে। দেশ সংস্কারের ডাক দিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজ। যারা আমাদের ত্রাতা এবং অহংকার। তাদের চোখেই আগামীর বাংলাদেশ দেখতে চাই। সংস্কারের ঢেউ এসে লেগেছে শিক্ষাঙ্গনেও। 

শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী মোড়লরা একে একে লেজ গুটিয়ে ইস্তফা দিচ্ছেন। কীসের আলামত? এদের হুংকারে জনগণ ছিল ভীতসন্ত্রস্ত। মত ও পথের চর্চা ছিল সংকুচিত। হাত ছিল অনেক লম্বা। একেকটা যেন আস্ত বড় ডাইনোসর। এখন কথা বলার সুযোগ এসেছে। নিশ্চিন্তে মনোভাব ব্যক্ত করার হিম্মত পাই। ফলত শিক্ষা নিকেতনে কেমন ভিসি দেখতে চাই এসবে যৎকিঞ্চিৎ ভাবতে আমরাও আগ্রহী হই।

ছাত্রবান্ধব শিক্ষানুরাগী রুচিসম্পন্ন একাডেমিক জগতের সফল আইকন কর্মে যিনি উত্তীর্ণ এমন মানুষকে আমরা খুঁজছি। আর এসব খুব বেশি কি অধরা? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দালাল বকধার্মিক দরবেশ বাবারা সরব এবং তদবিরের যে সংবাদ পাই তাতে শঙ্কিত হই। ভাবি এ জন্যই কি ছাত্র-জনতার এত রক্তদান? রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই তদবিরবাজদের মাঠে আস্ফালন এবং মহড়ার অপসংস্কৃতি। রবিঠাকুরের কথা মনে করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি কিন্তু মানুষ না।

এককালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপাচার্যদের সমাজ এবং দেশের আমজনতা শ্রদ্ধা এবং সমীহ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের তথ্যানুযায়ী এ দেশের শিক্ষার্থীদের পেছনে গড়ে বছরে ২ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। এ টাকা খেটে-খাওয়া মানুষের ঘামের। অথচ এসবে মানুষজন কখনোই প্রশ্ন তোলেনি। এসবই ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমের নমুনা। 

অথচ উচ্চশিক্ষিতরা কি পারছে এর মর্যাদা দিতে? দেশে ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর কি খুব প্রয়োজন? ভাবার সময় এসেছে। নতুন গজানো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগবাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বজনপ্রীতি চর্চার মওকা খুঁজতে গিয়ে শিক্ষকরা জড়ো হচ্ছেন দলীয় রাজনীতির পতাকাতলে। নেতার পদলেহনে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। সর্বত্র অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা। 

কথিত আইনাঘরের ভয়ে সুশীলসমাজ মুখে কুলুপ এঁটেছিল। অন্যায় তোষামোদী চর্চার মাধ্যমে বড়কর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ফলত যোগ্য কর্মঠ একাডেমিক ঘরানার পণ্ডিত ব্যক্তিরা এসবে অনীহা এবং অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। এককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি প্যানেল থেকে নিয়োগ হতো। সময়ের আবর্তে যেন এসব ইতিহাস। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছি?

ভিসি পদ কি আসলেই লোভনীয়? ইদানীংকালের নানা ঘটনাপ্রবাহ এবং ভিসির আমলনামা বিশ্লেষণে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়-কেন শিক্ষকরা এসবের দিকে নজর দেন? নিকট অতীতে দুর্নীতির টাকা পাচারে খোদ প্রধানমন্ত্রীর অফিস পিয়নের শতকোটি টাকার সংশ্লিষ্টতার যুগে শিক্ষকরাও এসবে গা ভাসিয়ে ওঠে-পড়ে লেগে যান। এ ক্ষেত্রে লেভেলিং তত্ত্ব বেশ কার্যকর। শিক্ষক নেতারা এ পদে আসার জন্য নানা জায়গায় কোটি টাকা বিনিয়োগেও পিছপা হয় না। থানার ওসির মতো নিয়োগ পাওয়ার পরপর হাজারগুণ মুনাফাসহ টাকা আমদানিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ যেন আজব খেলা!
ভিসির যোগ্যতা যেন দলবাজি, লেজুড়বৃত্তি এবং চাটুকারিতা।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পতিত ভিসি জুট ব্যবসায়ী লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির পা-চাটা শিক্ষক নেতা হিসেবে ২০১৫ সালের পে-স্কেলে তামাম শিক্ষক সমাজের সম্মানহানি এবং বেইমানি করে এ পদ ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি কি চাইলেই শিক্ষার্থীবান্ধব এবং অনুকূল শিক্ষা পরিবেশের যৌক্তিক ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারতেন? বিগত সময়ে দ্বিচারিতা এবং পল্টিবাজিতে আসক্তরাই সরকারের আদরের ধন হিসেবে প্রিয় পাত্র হতে পেরেছিলেন।

ব্যক্তিত্ব হচ্ছে যোগ্যতা এবং কার্যকরী নেতৃত্বের নিয়ামক শক্তি। ব্যক্তিত্বহীনরা অনেক কিছু অর্জন করতে পারলেও সাধারণ্যের ভালোবাসা এবং আনুকূল্য ভাগ্যে জোটে না। তারা অজগর সাপ। এদের গায়ে আগুন ঢেলে দিলেও নড়ে না। এবং পদ থেকে পদত্যাগ করতে চায় না। এরা বধির, এরা অন্ধ। 

ফিরে দেখা ১৬ জানুয়ারি ২০২২ শাবিপ্রবির তৎকালীন স্বৈরাচারী ভিসি যখন নিরীহ ছাত্রদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড গুলি বোমার হোলিতে মেতে উঠেছিলেন, প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েক দিনের অনশন ও আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট এবং গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রানীর লোক হিসেবে মাঠ কামড়ে স্বপদে থাকার চেষ্টা করেন। 

ছাত্ররা শেষতক ফুটবলে বোমা ফরিদ লিখে লাথি দিলেও এসবে থোড়াই কেয়ার করেন। অন্তত এমন আহ্লাদি ভিসি আমরা চাই না! সে সময়ের ভিসির আনুকূল্য প্রত্যাশীরা আজও মাঠে সজাগ এবং সোচ্চার। সেদিন যারা ছাত্রদের বিরুদ্ধে মাঠে ছিলেন খোলস পাল্টিয়ে নানাভাবে পদ ভাগাতে জীবনবৃত্তান্ত বগলদাবা করে তারা আজ তদবিরে ব্যস্ত। ছাত্ররা কি এ জন্য রক্ত দিয়েছিল? শঙ্কাটা কিন্তু এখানটায়।

ভিসিরা নানা অনিয়মে জড়ালেও এদের বিচারের নজির নেই। ফলত তারা এসবে উৎসাহ পায়। চরিত্র হলো সুযোগের অভাব। সুযোগ পেলেই এদের কুৎসিত অবয়ব ফুটে ওঠে। নিয়োগবাণিজ্য পদলেহন অবকাঠামো থেকে মাসোহারা কিচেন কেবিনেট তৎকালীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সখ্য এবং বেশ কিছু শিক্ষকের প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ ইন্ধনে এরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হাজারো অভিযোগে এদেরকে টলানো যায় না। 

এসব কাজে শক্তির প্রবাহ হিসেবে খেলোয়াড়ের ভূমিকায় থাকেন বেশ কিছু চাটুকার শিক্ষক। পদ-পদবিতে মধু আছে বলেই মৌমাছির মতো দালালরা কিচেন কেবিনেট-খ্যাত আয়নাঘরে নিয়মিত হাজিরা দেয়। এমনও শোনা যায়-রমজানে ইতিকাফের নতুন মডেল হিসেবে দিনের কিছুটা অংশ ভাগ-বাটোয়ারায় উপস্থিত থেকে আবার মসজিদে ফিরে গিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। মানুষকে হেয় করা প্রমোশন আটকানো খাসকামরায় নজরানার আশায় শিক্ষক-ছাত্রদের অপদস্থ করা নিত্যদিনকার কারবার ছিল। মেরুদণ্ডহীন শিক্ষকরা পা-চেটে আপস করে পদ-পদবি এবং প্রমোশন অবলীলায় ভাগিয়ে নিলেও শুরু থেকেই কোনো কোনো শিক্ষক প্রতিবাদও করেছেন জোরেশোরে। হয়েছেন হায়েনার রোষানলের শিকার। কথিত অযোগ্য ভিসিরা তাদের প্রমোশন বিলম্বিত করলেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ব্যক্তিত্ব এবং মননে ন্যূনতম চির ধরাতে পারেনি। শিক্ষকরা এসব যাবর কেটেই স্বস্তি পায়। কেননা সিংহের মতো বাঁচার মধ্যেই এরা সার্থকতা খোঁজে।

সময় এসেছে সংস্কারের। পরিবেশও বেশ অনুকূলে। যাদের হাত ধরে এদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, তাদের মনোবল এবং দৃঢ়তায় জনতা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। শিক্ষায় মনোযোগ বেশ জরুরি। এক্ষণে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা মেধাবী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রুচিশীল শিক্ষার্থীবান্ধব ভিসি চাই। যেখানটায় আয়নাঘর থাকবে না। যার পাশে বকধার্মিক ও দরবেশ বাবার উপস্থিতি থাকবে না। যেখানটায় বৈশ্বিক বাস্তবতায় শিক্ষার্থীবান্ধব ভিশনারি এবং কর্মঠ মানুষরা এ পদে আসার আগ্রহ দেখাবে। এবং চিরতরে দলকানা চাটুকার দালালমুক্ত স্বপ্নিল শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হবে। তবেই শিক্ষক ছাত্র-সংশ্লিষ্ট জানপ্রাণ উজাড় করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে উৎসাহিত হবে। তবেই দেখা মিলবে সুন্দর আগামীর।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সময়ের আলো/আরএস/





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close