ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

কৃষি খাতে গুরুত্ব বাড়াতে হবে
প্রকাশ: রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৪, ১:৪৯ এএম আপডেট: ১৮.০৮.২০২৪ ৭:৫৫ এএম  (ভিজিট : ৩৪৬)
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই আমাদের প্রধান অবলম্বন। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আমাদের ভরসা। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের জনগণের একটি বিশাল অংশ তাদের জীবন ধারণের জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদক দেশ।

আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। বিভিন্ন কারণে চারদিকে আজ পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। সেই ছোঁয়া কৃষিতেও লাগুক। কেননা এখন কৃষিতেও পরিবর্তন জরুরি।

শৈশব থেকে যেটা দেখে এসেছি-গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে কৃষিপণ্য ছিল। কৃষকের গোলাঘরে শস্যের কমতি ছিল না। তাই তো একসময় বলা হতো, গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, মাঠ ভরা ফসল-এই তো আমাদের গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ। সেই রূপ এখন দিন দিন কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক জীবনযাপনের অজুহাতে কৃষিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে চিরচেনা গ্রামের মানুষও। তাই হয়তো ভয়ংকর দুঃসময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কৃষিকে অবহেলা করলে এই দুঃসময় আমাদের জন্য অবধারিত। তাই আমার মনে হয়, যেকোনো দুর্ভিক্ষ বা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হলে আমাদের কৃষিকেই আগে গুরুত্ব দিতে হবে।

কৃষি ছাড়া কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব নয়। কৃষিপণ্যের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষি খাতকে উৎপাদনমুখী করতে হবে। ধরা যাক, আপনার কাছে প্রচুর টাকা আছে, অথচ বাজারে কোনো খাদ্যপণ্য নেই। কী হবে আপনার সেই প্রচুর টাকা দিয়ে? ওইসব টাকা দিয়ে কী কিনে খাবেন আপনি? এভাবেই যদি আমাদের গ্রামের সবাই প্রবাসে যান, তারা হয়তো প্রচুর ডলার  কামাতে পারবেন। জমি চাষ করার লোক না থাকলে সেই ডলার দিয়ে আপনার পরিবার কী কিনবেন? তাই প্রবাসে শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরও শ্রমিক হিসেবে নামতে হবে কৃষিজমিতে। তা হলেই হয়তো ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। 

বাংলা সাহিত্যের জীবনমুখী গল্পকার সুবোধ ঘোষের ‘তমসাবৃতা’ গল্পটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই গল্পে চাষিরা তাদের সব পণ্য একবার দ্বিগুণ দামে গঞ্জে বিক্রি করে দেয়। ফলে গঞ্জের মহাজনও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। তিন মাসের মধ্যে তাদের জমানো সব টাকা শেষ হয়ে গ্রামে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তাদের পরনের কাপড়ও জোটে না তখন। তাদের আরও সাত মাস অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী ফসলের জন্য। সেখানে জমিতে ফসল ফলিয়েও অভুক্ত থাকতে হয়েছে শুধু নিজেদের ভুলের কারণে। বস্ত্রহীন থাকতে হয়েছে নারীদের। ফলে রাতের অন্ধকারে ঘরের নারীরা নগ্ন দেহে জমিতে কাজ করেছে। সূর্য ওঠার আগে পৃথিবী অন্ধকার থাকতেই ঘরে ফিরতে হয়েছে তাদের। এভাবে অভাবে পড়েই তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নিজেদের ভুল শুধরে নেওয়ার উপায় খুঁজেছেন একসময়।

আমার নানা একটি ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। তারপরও তিনি নিজের জমিতে ধান, পাট, মেস্তা, আখ, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, টমেটো, খিরাই, বেগুন, ঢ্যাঁড়শ, তিল, তিসি, সরিষাসহ নানাবিধ শাকসবজি চাষ করতেন। ফজরের নামাজ পড়ে জমিতে যেতেন। সকালে মাদরাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি জমির পরিচর্যা করতেন। মাদরাসা থেকে এসেও জমিতে কাজ করতেন। নিজের উৎপাদিত শস্যেই তার বছর পার হয়ে যেত। আবার উদ্বৃত্ত শস্য বাজারে বিক্রিও করতেন। বাড়িতে ফল গাছও ছিল প্রচুর। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, গাব, নারিকেল, জাম-কোনো কিছুরই তো কমতি ছিল না। মাছ ও গরুর মাংস ছাড়া তেমন কিছু বাজার থেকে কিনতে হতো না। নানিও বাড়িতে হাঁস-মুরগি-ছাগল পালন করতেন। কিন্তু আমরা পরবর্তী প্রজন্ম আস্তে আস্তে কৃষিকাজ থেকে সরে গেছি। আমার মামা-মামাতো ভাই-বোনরা শহরমুখী হয়েছেন। তারা উচ্চ শিক্ষিত হয়েছেন। মামাতো ভাই আমেরিকায় অবস্থান করছেন। তাদের এখন সবকিছুই কিনে খেতে হয়। চাকরি-বাকরি করেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আমার বাবাও শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। বাড়িতে শাকসবজি করতেন। বর্ষায় নদী বা বিল থেকে মাছ ধরতেন। ভালো জাল বুনতেন। আমাদের চাল-ডাল তেমন কিনে খেতে হতো না। মাকে দেখতাম, বাড়ির খালি জায়গায় শাকসবজির চাষ করতেন। হাঁস-মুরগি পালন করতেন। এখনও সুযোগ পেলে করেন। স্বল্প পরিসরে সেসব টিকিয়ে রেখেছেন। জনবল সংকটের কারণে আগের মতো আর পারেন না। এদিকে এখন আমরা যারা শহরে থাকি, এসব বাজার থেকেই কিনে খাই। চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাই। মাসের অর্ধেক যেতে না যেতেই আমাদের মানিব্যাগ খালি হয়ে যায়। 

আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে কুলিয়ে উঠতে পারি না। অথচ এখনও গ্রামের মানুষ চাইলেই নিজের জমিতে উৎপাদিত ফসল দিয়ে এক বছর ভালোই চলতে পারেন। তবে সেটি আর খুব বেশি টিকে নেই। গ্রামেও এখন নাগরিক ছোঁয়া লেগে গেছে। কেউ কেউ কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কাজের লোক পাওয়া যায় না। বদলা-কামলার পেশাকে ঘৃণা করছেন অনেকেই। সবাই ছুটছেন শহরে কিংবা বিদেশে। আমার মনে হয়, একসময় তারাও হয়তো ফিরে এসে আফসোস করবেন এসবের জন্য। অতীতের জন্য হতাশ হবেন। কেননা কংক্রিটের মাঝে অর্থ ফলে, শস্য ফলে না।

আমি পেশাগত জীবনে গণমাধ্যমকর্মী। অন্য কাজের সঙ্গে পত্রিকার কৃষি বিভাগটাও দেখি। প্রতিদিন কৃষিবিষয়ক খবরগুলো প্রকাশ করি। সেখানে আমার দেশের কৃষকের সফলতার খবর প্রকাশ করে আনন্দিত হই। শিক্ষিত যুবকরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আমাদের কৃষিতে অবদান রাখছেন। ছবিতে সবুজ মাঠ, সোনালি শস্য দেখতে খুব ভালো লাগে। শৈশবে ফিরে যাই। পড়াশোনার পাশাপাশি আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি কৃষিকাজ করেছি। তাই এসব লেখা প্রকাশের মধ্য দিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। পাশাপাশি তাদের সমস্যার কথাও তুলে ধরি। একদিন হয়তো কৃষকের সংখ্যা বেড়ে বেকারের সংখ্যা কমে যাবে। এ ছাড়া তামিল সিনেমায় আমরা দেখি, কৃষিকে তারা কীভাবে গুরুত্ব দেন। শস্যকে তারা প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এসব সিনেমার মধ্য দিয়ে তারা কৃষিকে সম্মানিত করেন। অন্যকেও অনুপ্রাণিত করেন। 

মূলত সংকট তো মানুষই সৃষ্টি করে। আবার মানুষই সংকট নিরসন করে। শুধু দরকার একটু আন্তরিক প্রচেষ্টা। পৃথিবী তো মানুষের চেয়েও উদার। পৃথিবী মানুষকে দান করেই তৃপ্ত হয়। তাই তো প্রতিনিয়তই আমাদের দান করে যাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য তো পরিচর্যা দরকার। অথচ আমরা তো পৃথিবীকে অবহেলা করছি। 

সবাই জানি, শিক্ষাজীবনে ভালোভাবে পড়লে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু জমিতে ভালোভাবে চাষ না করলে ভালো শস্য পাবেন কীভাবে? তাই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষিত কৃষকও সৃষ্টি করা জরুরি। সবাইকে বুঝতে হবে, কৃষিকাজ কোনো নিন্দিত কাজ নয়। বরং কৃষিও বৃহৎ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। গর্বিত হওয়ার মতো কাজ। অন্য শিল্পেও পরিশ্রম করতে হয়। 

এখানেও পরিশ্রম করতে হবে। কাদা-জল মাখায় কোনো লজ্জা নেই। বরং গর্ব আছে। দেশকে ভালোবাসার অহংকার আছে। তাই সরকারকেও কৃষিতে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতি বছর কৃষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। সফল কৃষকদের পুরস্কৃত করতে হবে। কৃষি অফিসের কর্মচারীরা সরেজমিন কৃষকদের পরামর্শ দেবে। বীজ-সার দিয়ে সাহায্য করবে। এমনটাই কাম্য আমাদের। 

আমাদের জমি দিয়েছেন আবাদ করার জন্য। তাই আমাদের ফসলি জমি বাড়ানো উচিত। সব ধরনের জমি কৃষির আওতায় আনা উচিত। হোক শস্য কিংবা শাকসবজি। কৃষিপণ্য কিনে আনার চেয়ে নিজে উৎপাদন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কৃষিও হতে পারে একটি দেশের প্রধান শিল্প। শুধু দরকার আমাদের উন্নত মানসিকতা। দরকার ইতিবাচক ভূমিকা। সব ধরনের দুর্গতি দূর হোক। ফুল, ফল, ফসলে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ। সমৃদ্ধ হোক সোনার বাংলাদেশ।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close