ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

জীবন বাঁচাবে ভূমি পরিকল্পনা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪, ৩:২৫ এএম  (ভিজিট : ১৮৬)
নগরে খোলা জায়গা কম, জনবসতির আধিক্য এবং সেই অধিক জন ঘনত্বের আবাসন, কর্ম, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করার জন্যে প্রচুর বহুতল ভবন তৈরি করতে হয়। পরিকল্পিত নগরগুলোতে ভূমিকম্প, সুনামি, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মাথায় রেখেই নগর পরিকল্পনা করা হয় এবং নগরের ভবনগুলোও দুর্যোগ সহনীয় করেই নকশা করা হয়। 

তাই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পেও মানুষ নিরাপদ থাকে অনেকটাই, প্রাণহানিও হয় অনেক কম। কিন্তু নগর যদি আমাদের রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর মতো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে  ওঠে তবে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণ। নগরাঞ্চলে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো ভূমিকম্প।

ভূমিকম্প হলো সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক বিপদ যা যেকোনো সময় ঘটতে পারে কোনো সতর্কতা ছাড়াই। ভবন, অবকাঠামো এবং সর্বোপরি ধ্বংস করতে পারে মানুষের বসতি, জন্ম দেয় ট্র্যাজেডি। আমাদের রাজধানী ঢাকা ও অন্য শহরগুলো রয়েছে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে। বলা হয়ে থাকে ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা শহর ধ্বংস্তূপে পরিণত হবে। এটা যে শুধু গবেষকদের আশঙ্কা তা কিন্তু নয়। প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের ঠেলে দিচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। যেকোনো দুর্যোগের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় মেনে চলা হয়- দুর্যোগ-পূর্ব প্রস্তুতি বা ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বা ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট। 

যদিও নিকট অতীতে ঢাকা শহরে মাঝারি থেকে বড় কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানেনি, এটি প্রায় সারা বছরই ছোটখাটো কম্পন অনুভব করেছে যা অঞ্চলটিকে ভূমিকম্পগতভাবে সক্রিয় নির্দেশ করে। কিন্তু ঢাকা শহর যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্পে দুর্যোগ ঝুঁকি কল্পনাতীত। 

নগর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হলো ভূমি ব্যবহার এলাকা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা। সঠিক ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে ভবনগুলো জোন মোতাবেক স্থাপিত হয়। এরপর আসে রাস্তাঘাট। ঢাকা শহরে রাস্তার পরিমাণ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক কম। পুরান ঢাকা তো বটেই সমগ্র ঢাকা শহরের বেশিরভাগ জায়গাতেই রাস্তার পরিমাণ কম এবং রাস্তাগুলো যথোপযুক্ত প্রশস্তও নয়। উপরন্তু ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের বহুতল ভবনগুলোর একটা বড় অংশ যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরি হয় না বিধায় সেগুলো কাঠামোগতভাবে দুর্বল হয়ে থাকে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দুর্বল কাঠামো দুর্যোগ, বিশেষ করে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে প্রাণহানি ও সম্পদহানির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। 

এ ছাড়াও ঢাকাসহ আমাদের অন্য শহরগুলোতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে যা ভূমিকম্প হলে ফেটে গিয়ে ঘটাতে পারে অগ্নিকাণ্ডের মতো ভরাবহ বিপর্যয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে নগর পরিকল্পনা ও স্থাপনা নির্মাণের দিক থেকে আমরা ভূমিকম্পের ভয়াবহতা মোকাবিলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নই। প্রথমেই আসা যাক, ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার বিষয়টিতে। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে যথোপযুক্ত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নগর পরিকল্পনার ভাষায় একে বলা হয় ‘রিস্ক সেন্সিটিভ ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিং’। এই পদ্ধতির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল- এতে দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলা ও প্রশমন বিষয়টিকে নগর বা অঞ্চল পরিকল্পনার একেবারে শুরু থেকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে সঠিক ঝুঁকি শনাক্তকরণের মাধ্যমে তা পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবহার কেমন হবে, রাস্তার প্রস্থ কতটা হবে, ভবনের ধরন, উন্মুক্ত স্থানের অবস্থান এবং সর্বোপরি জনঘনত্বের বিষয়টি অবশ্য বিবেচ্য। ঢাকা ও দেশের অন্য শহরগুলোকে ভূমিকম্প ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে ‘রিস্ক সেন্সিটিভ ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিং’ এর নীতিমালা অনুসরণ ও বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়টি মাথায় রাখা হয় কম। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত এবং মোটামুটি কঠোর। এ ধরনের পরিকল্পনা ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে তেমন বিশেষ গুরুত্ব রাখতে পাওে না এবং আমাদের নগরগুলোর ক্ষেত্রে হচ্ছেও তাই। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন সেক্টর একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ও সম্পূরক হলেও এদের কার্যপদ্ধতি ও বাস্তবায়নে দেখা যায় সমন্বয়হীনতা। ফলে নগরগুলোও গড়ে ওঠে অপরিকল্পিত ভাবেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমাদের সড়কগুলোর কথা। 

রাজপথ ও অন্যান্য মধ্যবর্তী সড়ক যেগুলো পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে প্রশস্ততা ও উপযোগিতার বিচারে সেগুলো ঠিকঠাক থাকলেও বেশিরভাগ রাস্তাই অপরিকল্পিত তথা অপ্রশস্ত। এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-এর বিধি মোতাবেক রাস্তার দৈর্ঘ্য ন্যূনতম ৯ ফুট (২.৭৫ মিটার) না হলে কোনো স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জমির মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ছেড়ে রাস্তা প্রশস্ত করার জায়গা করে দিতে হবে। ভূমিকম্প বা অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে সড়ক প্রশস্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যদিও পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ এ বিধানকে শিথিল করা হয়েছে এবং বলায় হয়েছে ২.৭৫ মিটারের কম প্রশস্ত রাস্তার পাশেও বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে, যা একটি ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ প্রশমনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট অন্তরায়।

ঢাকা ও অন্যান্য শহরের জন্য একেবারে শুরু থেকেই পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের যে ব্যবস্থা চালু আছে তা ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভূমিকম্পের ফলে পাইপলাইল ফেটে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা শুধু যে জান মালের ক্ষতি করবে তাই নয়, ঘটাবে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। সেভাবে দেখলে এ গ্যাস পাইপাইনগুলো আমাদের নগরগুলোর নিচে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। অনেকের মনেই একটা ভুল ধারণা আছে যে, হাই রাইজ বিল্ডিং বা উঁচু ভবন মানেই ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। এটি সম্পূর্ণ ভুল। ভবনের আয়ু উচ্চতার ওপর না, তার শক্তিশালী কাঠামো, যথোপযুক্ত নির্মাণশৈলী ও উন্নত নির্মাণ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে আর সঙ্গে তো মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী আছেই।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এসব উদ্যোগই ব্যর্থ হবে যদি সঠিক নগর পরিকল্পনা, উপযুক্ত উপায়ে স্থাপত্য নির্মাণ করা না হয়। পুরাতন ভবনগুলোকে রক্ষা করার সময় এটাই। বড় মাত্রার ঢাকা মেডিকেল কলেজ একটি আপদকালীন চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। সুতরাং এর রেট্রোফিটিং অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে আছে। আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্ক হওয়া এবং সেভাবে নগরগুলোকে গড়ে তোলা।

লেখিকা: স্থপতি ও নগরবিদ

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close