ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

পোড়া ছাই থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
প্রকাশ: রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০২৪, ৩:০৪ এএম  (ভিজিট : ৩৪০)
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই রাজধানীসহ সারা দেশে চার শতাধিক থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। থানার ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়েছে, হয়েছে অস্ত্র লুটপাট। এই হামলায় ভেঙে পড়ে থানার সার্বিক কার্যক্রম। নিহত ও আহত হয়েছেন কয়েকশত পুলিশ সদস্য। জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে যান পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও থানায় ফিরতে শুরু করেছেন পুলিশ সদস্যরা। থানার পোড়া ছাই ও আবর্জনা পরিষ্কার করছেন শিক্ষার্থীরা। এই পোড়া ছাই থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বাহিনীটি। রাজধানীর থানাগুলোতে সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা নিরাপত্তা দিচ্ছেন। তা ছাড়া সারা দেশে সেনা টহলের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসছে।  

রাজধানীতে ৫০ থানার মধ্যে ৪৫ থানার কার্যক্রম স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে। বাকি পাঁচ থানা হলো-যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পূর্ব, খিলক্ষেত, পল্টন ও কদমতলী থানা। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেলের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, ডিএমপির ৫০ থানার মধ্যে ৪৫ থানার কার্যক্রম স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে। বাকি পাঁচ থানার কার্যক্রম দুয়েক দিনের মধ্যে শুরু হবে। অনেক থানা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেসব থানার কার্যক্রম পুলিশ ফাঁড়িতে পরিচালিত হচ্ছে।   

অন্যদিকে শনিবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানা ঘুরে দেখা যায় ক্ষতবিক্ষত থানার মধ্যেই স্বল্প পরিসরে থানার কার্যক্রম চলছে। বেশ কয়েকটি থানায় শিক্ষার্থীদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালাতে দেখা যায়। তবে থানাগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যদেরও দেখা গেছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় সরেজমিন দেখা যায়, থানা ও থানার ভেতরে পুলিশ সদস্যদের আবাসিক দুটি ভবন সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। থানায় প্রবেশ করেই ডান পাশে প্রথমে চোখে পড়ে বেশ কয়েকটি ভাঙচুর করা গাড়ি পড়ে আছে। বাম পাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি পুড়ে যাওয়া গাড়ি। থানা ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধু কর্নার ভেঙে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পাশেই থানা থেকে ময়লাভর্তি বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ জড়ো করে রাখছেন শিক্ষার্থীরা। থানার পেছনে যেখা যায় বেশ কয়েকটি গাড়ি পোড়া অবস্থায় পড়ে আছে। এ সময় দেখা যায়, দুই পুলিশ সদস্য গাড়িগুলোর হিসাব করে খাতায় লিপিবদ্ধ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, থানায় আক্রমণ করে থানার ভেতরের মালামাল লুটের পাশাপাশি থানায় থাকা অনেক যানবাহন নিয়ে গেছে দুষ্কৃতকারীরা। সব থেকে বেশি নিয়েছে সিএনজি। তবে কী পরিমাণ সিএনজি নিয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি তারা। এ ছাড়া অনেক গাড়ির যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেছে।

থানার পেছনে দুটি ছয় তলা ভবনে থাকতেন পুলিশ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। দুপুরে ভবন দুটির সামনে একজন আনসার সদস্যকে পাহারায় দেখা যায়। তিনি জানান, দুষ্কৃতকারীরা থানা লুটের পাশাপাশি এই দুই ভবনেও ভাঙচুর ও লুটপাট করে। ভবন দুইটি ঘুরে দেখা যায়, দুই ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাটে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। আসবাবপত্র বেশিরভাগ নিয়ে গেছে। যেগুলো ছিল তাও ভেঙেচুরে রেখে গেছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পোশাকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। ভেতর থেকে ভেসে আসছিল দুর্গন্ধ। থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এই ফ্ল্যাটগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারের পাশাপাশি বদলি হওয়া অনেক পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা থাকতেন। ঘটনার দিনে আক্রমণের আগে সবাইকে ভবন থেকে বের করে নেওয়া হয়। তার পরই চলে তাণ্ডব।

চার তলা থানা ভবনের প্রথম দুই ফ্লোরে চলত থানার কার্যক্রম এবং ওপরের দুই ফ্লোরের ব্যারাকে থাকতেন পুলিশ সদস্যরা। নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলায় বেশিরভাগ কক্ষেই লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সেই কক্ষগুলো পরিষ্কার করছিলেন। তখনও কয়েকটি কক্ষে পোড়া ছাইয়ের স্তূপ ছিল। 

শিক্ষার্থীরা জানান, মানবতা ও দেশের স্বার্থে তারা থানা পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন, তাদের হাত ধরে দেশ খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। থানার ভেতরে পুড়ে যাওয়া কক্ষগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মামলার গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। লুট হয়েছে অনেক অস্ত্র ও গুলি। কক্ষগুলোর ভেতর ফার্নিচার থেকে শুরু করে কিছুই রাখেনি দুষ্কৃতকারীরা। নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলায় এখনও রয়েছে কালো ধোঁয়ার দাগ।

তিন ও চার তলায় পুলিশ সদস্যদের থাকার স্থানে দুই তলা মিলিয়ে ১০ জনের মতো পুলিশ সদস্যের দেখা মিলেছে। এ দুই ফ্লোরে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের জিনিসপত্র রাখার জন্য ট্রাঙ্ক ও কয়েকটি লকার ছিল। সবকয়টি ট্রাঙ্ক নিয়ে গেছে। এ ছাড়া লকারগুলো ভেঙে টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান সবকিছু নিয়ে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবকিছু।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, এখনও বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য থানায় ফেরেননি। থানা লুটের সময় পুলিশ সদস্যরা ডিউটিতে বিভিন্ন এলাকায় ছিলেন। তাদের টাকা এবং মোবাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু নিয়ে গেছে। থানার ফ্যান পর্যন্ত রাখে নাই। তিন-চার তলা এখনও পরিষ্কার করা হচ্ছে না। কারণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লার মধ্যে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র থাকতে পারে। তাই সবাই থানায় না ফেরা পর্যন্ত এগুলো পরিষ্কার করা হবে না।

অন্যদিকে সরজমিনে রাজধানীর ধানমন্ডি মডেল থানায় দেখা যায়, থানার প্রধান ফটকের পাশেই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত একটি গাড়ি পড়ে আছে। তা ছাড়া আরও কিছু গাড়ি পোড়ানো হলেও সেগুলো ইতিমধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার কর্মকর্তারা। আন্দোলনকারীদের হামলায় ভবনের বিভিন্ন অংশ ভাঙচুরের চিত্রও দেখা যায়। তবে ভাঙচুর করা অংশ সংস্কার করে কার্যক্রম শুরু করেছে থানা পুলিশ। স্বল্প পরিসরে থানার কার্যক্রম শুরু হলেও এখনও সম্পূর্ণভাবে চালু হয়নি। থানার বাইরে কোনো দায়িত্ব পালন করছে না পুলিশ। থানার সামনে ও ভেতরে আনসার ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে রেখেছেন। এখনও সব পুলিশ সদস্য থানায় ফেরেননি। যারা এসেছেন, তারাও আতঙ্কে আছেন। কেউ কেউ এসে হাজিরা দিয়ে আবার চলে গেছেন বলে জানা যায়। কারণ তারা থানায় থাকতে নিরাপদ বোধ করছেন না। থানার ভেতরে অন্যান্য সময়ের মতো মানুষের সমাগমও লক্ষ করা যায়নি।

থানার পুলিশ সদস্যরা জানান, সরকার পুলিশ সদস্যদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছে। তাদের নিয়ে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে সরকারের লাঠিয়াল ও নির্যাতন বাহিনীতে রূপ দেওয়া হয়েছে। সে জন্য পুলিশের পোশাক পরিবর্তনসহ ১১ দফা দাবি জানান তারা। এ ছাড়া পুলিশের পোশাকে হামলা ও মৃত্যুর ভয়ে তারা পোশাক পরতে অনীহা প্রকাশ করেন। পুলিশের পোশাক পরায় কোনো কোনো পুলিশ সদস্য মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছেন বলেও জানা যায়। 

ধানমন্ডি মডেল থানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তা এসআই আবদুর রাজ্জাক সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের কার্যক্রম স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে। তবে সম্পূর্ণভাবে চালু হতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে। কারণ অধিকাংশ পুলিশ সদস্য এলেও তারা হাজিরা দিয়ে চলে যাচ্ছেন। যদিও থানার নিরাপত্তার জন্য আনসার ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন। আমাদের অনেকগুলো গাড়ি পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। থানার কাচ ও বিভিন্ন জিনিস ভাঙচুর করে। 

তিনি আরও বলেন, এখনও আমাদের মধ্যে জীবনের হুমকি রয়েছে। যেকোনো সময় আমাদের ওপর হামলা হতে পারে। তারপরও আমরা দায়িত্ব পালন করছি। তবে নিরাপত্তাহীনতার কারণে কিছু দিন আমরা থানায় আসিনি। আমরা আপাতত থানার ভেতরে থেকেই সব ধরনের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বাইরের কোনো কাজ থাকলে আনসার বা সেনাবাহিনীর সদস্যদের দিয়ে করানোর চেষ্টা করছি।


সময়ের আলো/আরএস/ 




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close