সীমান্তপথে অবৈধভাবে ঢলের মতো আসছে ভারতীয় গরু। প্রায় ২৫-৩০ জনের চোরাকারবারী সিন্ডিকেট দিনে-দুপুরে এসব গরু আমদানি করলেও জানে না সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। স্থানীয় ইজারাদারের কাছ থেকে রসিদ বই কেটে বৈধ গরু বানিয়ে ভটভটিযোগে প্রকাশ্যে আশপাশের হাটবাজারগুলোতে বেচাবিক্রি হলেও জানে না সংশ্লিষ্ট অন্যরাও। চোরাকারবারীদের এমন নৈরাজ্য চলছে ভারতঘেঁষা শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার তিন গ্রামে।
গত কয়েক দিন ধরে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের পানিহাটা, মায়াঘাসি ও রামচন্দ্রকুড়া গ্রামে ২৫-৩০ জনের পাচারকারীর একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ৭টি দলে বিভক্ত হয়ে ভারত সীমান্তের ১১৮ ও ১১৯ নং সীমানা পিলার সংলগ্ন পানিহাটা ফেকামারী, মারাংগুপ ও সংলগ্ন হালুয়াঘাটের রঙ্গনপাড়া বা বানাই চিরিঙ্গিপাড়া সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে প্রতিনিয়ত আমদানি করা হচ্ছে ভারতীয় গরু।
পাচারকারী ও এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ গরু আনা হচ্ছে দিনের বেলায়। বিশেষ করে দুপুর বেলা বেশি আনা হচ্ছে ভারতীয় গরু। প্রতিটি গরু সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত থেকে বাংলাদেশে আনার জন্য রয়েছে আলাদা জনবল। দরিদ্র পরিবারের যুবকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গরু পার করে দেয় দুই দেশের সীমান্ত। গরুপ্রতি মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে তারা করছে এই কাজ। এরপর চোরাকারবারীদের বাড়িতে রেখে ওইসব গরু মুহূর্তেই হয়ে যায় বাংলাদেশি গরু। এ জন্য রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের ঘাকপাড়া বাজারের গরুর হাটের ইজারাদার কর্তৃপক্ষ তাদের রসিদ বই ব্যবহার করে হাটে বেচাকেনার মূল্য আদায় করে ধরিয়ে দেয় রসিদ। ফলে একটু পরই চোরাই পথে আনা ওইসব ভারতীয় গরু আইনের চোখে হয়ে যায় দেশীয় গরু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতীয় এসব গরু চোরাই পথে আনতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর স্থানীয় কতিপয় সদস্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট মাসোহারায় চুক্তি রয়েছে। চুক্তি রয়েছে স্থানীয় অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও। ফলে দিনের বেলায় নির্বিঘ্নে চোরাই পথে আনা ভারতীয় গরু আবার দিনের বেলাতেই আশপাশের উপজেলার হাটবাজারে ভটভটিযোগে পাইকারের হাত হয়ে চলে যায় বিক্রির জন্য।
কৌশলে পাচারকারী চক্র ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ কোনো পরিস্থিতির কারণে গরু পাচার কখনো কখনো কিছুটা কমলেও সম্প্রতি প্রতি সপ্তাহে শতাধিক গরু পাচার হচ্ছে সীমান্তের এ পথে। এ ছাড়াও ভারতীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, ইয়াবা, ভারতীয় শাড়ি, থান কাপড়সহ আরও একাধিক পণ্য প্রায়ই এ পথে পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসছে। ইতিমধ্যেই মাদক ও শাড়ির চালান জব্দ করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হলেও ভারতীয় গরু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্ট কাউকেই। ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে এ সীমান্তে গরু পাচারকারীর সংখ্যা। উপরন্তু অনেকটা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে এ ব্যবসা করছে গরু পাচারকারীরা।
এদিকে সম্প্রতি কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী ও গ্রাম পুলিশসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দিনভর গরু পাচারকারীদের ভারতীয় গরু অনুসন্ধান শেষে সন্ধ্যায় ফিসারী শাহজাহানের বাড়ির একটি মাটির দালান থেকে আবদ্ধ অবস্থায় ১২টি ভারতীয় মাঝারি ধরনের ষাঁড় দেখতে পান। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বেওয়ারিশ গরু হিসেবে সেগুলোকে সরকার অনুমোদিত খোয়াড়ে প্রেরণ করেন।
ঘাকপাড়া গরুর হাট ইজারাদারদের একজন মায়াঘাসি গ্রামের শাহজাহান। ভারতীয় গরুর বৈধতা দিতে তাদের হাটের জমার রসিদ ব্যবহার করে জমা আদায়ের কথা অকপটে স্বীকার করেন তিনি। এ বিষয়ে বিজিবির স্থানীয় কোম্পানির দায়িত্বশীল একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা বিষয়টি অবগত আছি এবং গরু চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি আশা করব, বিষয়টিকে বিজিবি সতর্কতার সঙ্গে দেখবে। তিনি আরও বলেন, চালান দেখানো মাত্রই কিন্তু সে বৈধতা পেয়ে গেল না। গরুটি যার কাছ থেকে কিনেছে ওই বিক্রেতার বাড়ি গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে প্রকৃতপক্ষে ওই ব্যক্তি আগে থেকেই ওই গরুর মালিক ছিল কি না তা যাচাই-বাছাই করে তারপর ব্যবস্থা নিতে হবে।