ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় মর্জিনার সংগ্রাম
প্রকাশ: বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪, ২:৪৩ এএম  (ভিজিট : ১৯৮)
সামর্থ্য কিংবা সক্ষমতা না থাকলেও তিন সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর জামালপুর পৌরশহরের জংগলপাড়া বোর্ডঘর এলাকার দরিদ্র রিকশাচালকের স্ত্রী মর্জিনা বেগম। হৃদরোগে আক্রান্ত অসুস্থ স্বামীর যৎসামান্য আয়ে সংসারের খরচ না চলায় মর্জিনা নিজেই শুরু করেছেন বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য বিক্রির ব্যবসা।

জামালপুর পৌরশহরের জংগলপাড়া বোর্ডঘর এলাকার রিকশাচালক মৃত মতিউর রহমানের মেয়ে মর্জিনা বেগম। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে মর্জিনা সবার বড়। মা জহুরা বেওয়া এখনও এলাকার একটি বয়লার মিলে কাজ করছেন। অভাবের সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে মায়ের সঙ্গে মর্জিনাও কিছুদিন কাজ করেন স্থানীয় একটি বয়লার মিলে। এভাবেই চলতে তাকে মর্জিনাদের সংসার। রিকশাচালক বাবা মতিউর প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছিল ছয় সদস্যের বড় সংসার চালাতে। অবশেষে অনেকটা বাধ্য হয়েই ১৯৯৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয় মর্জিনাকে। জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া কালীবাড়ি দামেশ্বর এলাকার মৃত রসুল শেখের ছেলে দরিদ্র রিকশাচালক রমজান শেখের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। 

অভাবের সংসার থেকে হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বেশ বেকায়দায় পড়েন মর্জিনা। এদিকে রিকশাচালক রমজানও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় রমজান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রমজানের রিকশা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় সংসারের হাল ধরেন মর্জিনা। বিয়ের পরপরই এত বড় দায়িত্ব কাঁধে চেপে বসায় বেশ পেরেশানির মুখে পড়েন তিনি। মাত্র একশ টাকা বেতনে মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করা শুরু করেন তিনি। কিন্তু অভাবের সংসার তো এই খরচে চলে না। ধীরে ধীরে মুরগি পালা শুরু করেন তিনি। তার হাড়ভাঙা পরিশ্রমের গুণেই সংসারে সবার মুখে হাসি ফোটে। মুরগি বড় হয়ে গেলে ডিম ও বাচ্চা বিক্রি করে হাঁস পালতে শুরু করেন তিনি। 

একটা সময়ে হাঁস-মুরগি দুই খামারই ছেড়ে দেন মর্জিনা। সব বিক্রি করে শুরু করেন গরু পালন। পাশাপাশি জংগলপাড়া বোর্ডঘর এলাকায় ২০০৯ সালে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে তাতে শুরু করেন বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যের বেচাকেনা। এত উত্থান-পতনের মাঝেও মর্জিনা-রমজানের ঘর আলো করে এসেছে তিন সন্তান। তাদের শিক্ষিত করার স্বপ্নে বিভোর মর্জিনা।

মর্জিনার দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানের বিভিন্ন স্থানে থরে থরে সাজানো বাঁশের বেতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে মাছ ধরার পলো, খাঁচা, টুকরি, আদলা খাঁচা, ঢালাই খাঁচা, কুলা, চালুন, হাতপাখা, মাছ ধরার বাইর, কাইঠা বাইর, উছা, ধারাই, পাইপ লাকড়ি, পান-ঢালা, ঝাঁটা, বারুন, ফুলঝাড়ু, সিমেন্টের তৈরি চুলা ইত্যাদি নানা সামগ্রী। এসব সামগ্রী তিনি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। 

মর্জিনা তার দোকানের বিক্রয় সামগ্রী আনা-নেওয়ার জন্য স্বামী রমজান শেখকে একটি বেসরকারি ঋণদান প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত একটি পুরোনো অটোরিকশা কিনে দেন। ওই রিকশা দিয়ে স্বামী ও মর্জিনা জেলার ঢেংগারগড়, শাহবাজপুর, ছুইনটা বাজার, কালীবাড়ি, নান্দিনা, বেরা পাথালিয়া এবং জেলার মেলান্দহ ও ইসলামপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বাঁশের তৈরি নানা সামগ্রী সংগ্রহ করে দোকানে এনে তা বিক্রি করছেন। এতে ধীরে ধীরে তাদের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হতে শুরু করে।
মর্জিনার দোকানে এখন প্রতিদিন গড়ে ৩-৪ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে। মর্জিনার দোকানে কুলা কিনতে আসা জিগাতলা এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী রূপসী আক্তার বলেন, নারীরা যে পরিশ্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে-মর্জিনা বেগম তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কষ্টের পর সাফল্যের মুখ দেখছেন মর্জিনা। মর্জিনা বলেন, আমি এবং আমার স্বামী দুজনই নিরক্ষর। আমরা লেখাপাড়া জানি না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যত কষ্টই হোক না কেন, আমরা আমাদের সন্তানদের নিরক্ষর রাখব না। তাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলব।

মর্জিনার ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে। তার মেজো মেয়ে জান্নাত আরা স্থানীয় জেডি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী। ক্লাসে ওর রোল এক। বড় ছেলে মুস্রাফিলও একই স্কুলের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র আর ছোট ছেলে মুত্তাকিম স্থানীয় একটি মাদরাসায় লেখাপড়া করছে। সন্তানদের শিক্ষিত, আদর্শবান ও নিষ্ঠাবান সৎ নাগরিক হিসেবে তাদের বড় করার স্বপ্নে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মর্জিনার মুখ। স্বপ্ন পূরণের জন্য সবার কাছে দোয়া চান তিনি

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close