ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

শিশু-কিশোররা কেন অপরাধী হয়
প্রকাশ: শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১:৩২ এএম আপডেট: ২৭.০৭.২০২৪ ৮:০৩ এএম  (ভিজিট : ২৮৯)
শিশু-কিশোররা ফুলের মতো। তবে অযত্ন-অবহেলায় সে ফুল ঝরেও যেতে পারে। আমরা বলি, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। অথচ সেই শিশুই কিনা আবার কৈশোরে হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর অপরাধী। সঠিক দিকনির্দেশনা না পেলে তারাও বিগড়ে যেতে পারে। কেননা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘তেরো চৌদ্দ বছরের মতো এমন বালাই আর নেই।’
 
কবির এ কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ বলতে হচ্ছে আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এখন সেই ‘বালাই’ আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় এসব কিশোরের দাপট বা বিশৃঙ্খলায় তটস্থ মানুষ। কেন এমন হচ্ছে? কিশোর অপরাধ কেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল? গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। প্রতিনিয়তই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে সবখানে। যা পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য মোটেই সুখকর নয়।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আধুনিক বিশ্বের অসংগঠিত সমাজব্যবস্থায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের নেতিবাচক ফল হলো কিশোর অপরাধ। পরিবার কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন, শহর ও বস্তির ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ এবং সমাজজীবনে বিরাজমান নৈরাজ্য ও হতাশা কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। অপসংস্কৃতির বাঁধভাঙা জোয়ারও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। পরিষ্কার করে বলতে গেলে, কম বয়সে অপরিমিত অর্থপ্রাপ্তি, অপ্রাপ্তবয়স্কের হাতে স্মার্টফোন, অসৎ সঙ্গ, অতিরিক্ত উচ্চাশা, পারিবারিক হতাশা, রাজনৈতিক সংস্পর্শ ও অপসংস্কৃতির ছোঁয়া কিশোর-কিশোরীদের অপরাধপ্রবণ করে তুলতে পারে।

তাদের অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বয়সের দিক থেকে তারা সাধারণত ১০-১৬ বছর বয়সি। তবে বিভিন্ন দেশে বয়সের পার্থক্যও লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো দেশে ১৩ থেকে ২২ বছর। আবার কোনো দেশে ১৬ থেকে ২১ বছরকে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া জাপানে ১৪ বছর, ফিলিপাইনে ৯ বছর এবং ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে ৭ বছরের নিচের বয়সিদের অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। তবে বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়। 

তাদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক মনে করা হয়। ফলে অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যে কারণে তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়। তাই শীর্ষশ্রেণির অপরাধীরা কিশোরদের টার্গেট করে। প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর প্রলোভনে কিশোররা এসব অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।

অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায়, এ বয়সের ছেলেমেয়ের সামনে থাকে অদম্য আশা। জীবন সম্পর্কে থাকে খুব বেশি কৌতূহল। কখনো কখনো প্রতিকূল পরিবেশের কারণে আশাভঙ্গের বেদনায় হতাশার হাত ধরে নৈরাশ্যের অন্ধকারে পতিত হয় তারা। ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধ সম্পর্কে অপরাধ বিজ্ঞানী বিসলার বলেছেন, ‘কিশোর অপরাধ হলো প্রচলিত সামাজিক নিয়ম-কানুনের ওপর অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরদের অবৈধ হস্তক্ষেপ।’ 

আরেকজন অপরাধ বিজ্ঞানী বার্ট বলেছেন, ‘কোনো শিশুকে তখনই অপরাধী মনে করতে হবে, যখন তার অসামাজিক কাজ বা অপরাধপ্রবণতার জন্য আইনগত ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়।’ মূল কথা হচ্ছে বিশেষ ধরনের অস্বাভাবিক ও সমাজবিরোধী কাজ, যা কিশোর-কিশোরীরা সংঘটিত করে তাকে কিশোর অপরাধ বলা যায়।

তারা চিন্তাভাবনা না করে আবেগের বশবর্তী হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের কারণে খুব সহজে কম সময়ে প্রভাবিত হয়। তারা উদ্দেশ্যহীনভাবে, কৌতূহলবশত বা নিজেকে মানুষের সামনে ক্ষমতাবান হিসেবে জাহির করার জন্য অপরাধ করে থাকে। অনেক সময় প্রভাবশালী অপরাধীরাও কিশোরদের প্রভাবিত করে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সাহসী হয়ে ওঠে কিশোররা। সমাজের শীর্ষস্থানীয় অপরাধীরা অর্থ ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে কিশোরদের অপরাধে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কিশোরদের ব্যবহার করে থাকে।

অনেক সময় অনেকে অপ্রাপ্ত বয়সে না বুঝেও অপরাধ করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ পরিচর্যা পেলে শোধরানোর সুযোগ থাকে। আবার কখনো কখনো প্রতিকূল পরিবেশে সামাজিক সংগঠন ও কার্যাবলির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরেও সমাজবিরোধী কাজ করে। 

তারা সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়মশৃঙ্খলার তোয়াক্কা করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজের চিন্তা ও পছন্দকেই সঠিক বলে ধরে নেয়। কেউ কেউ অতি-উৎসাহ ও কৌতূহলের বশে উদ্দেশ্যহীনভাবে অসামাজিক কাজ করে। কিংবা অ্যাডভেঞ্চারাস ভেবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই যথাসময়ে তাদের সংশোধন করা না হলে ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে থাকে।

কিশোর অপরাধ এখন একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে পরিগণিত। অপরাধ জগতে তাদের পদচারণ বেড়েই চলেছে। গ্রামে কিংবা শহরে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সর্বত্রই কিশোর অপরাধ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এসব অপরাধীর মধ্যে জুয়া খেলা, মাদকাসক্তি, মারামারি-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, পরিবহনে টিকেট ছাড়া ভ্রমণ, পরীক্ষায় নকল করা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, রাস্তাঘাটে ছিনতাই, অপহরণ, খুন, ইভটিজিং, ধর্ষণ, এমনকি অন্যের গাছের ফল ও জমির ফসল চুরি করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, কম উন্নত সমাজেও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ প্রবণতা অকল্পনীয়ভাবে বাড়ছে। বিত্তশালী সমাজের আদরের দুলালদের অ্যাডভেঞ্চারাস অপরাধের পাশাপাশি সমাজে বিদ্যমান হতাশা, নৈরাজ্য আর দারিদ্র্য নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিশোরদেরও অপরাধপ্রবণ করে তুলছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোররাও চুরি, ছিনতাই, পকেটমারের মতো অপরাধমূলক কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ভগ্ন পরিবার ও দাম্পত্য কলহ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার অভাব, চরম দারিদ্র্য, বাবা-মায়ের অবহেলা, জোরপূর্বক শিশুশ্রম, খারাপ সঙ্গী, পারিবারিক অস্থিতিশীলতা, বাবা-মায়ের পুনর্বিবাহ, কর্মজীবী মায়ের অযত্ন-অবহেলা, নিঃসঙ্গতা, অতিরিক্ত শাসন, রক্ষণশীলতা, স্বার্থপর রাজনীতির ব্যবহার, নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশের কারণেও কিশোররা অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

এসব অপরাধের কারণে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। এসব কিশোর বড়দের প্রতি অবাধ্য হচ্ছে, অশোভন আচরণ করছে, পারিবারিক শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। সর্বোপরি কিশোরদের অর্থবহ ফুলের মতো নিষ্পাপ জীবনটি ধ্বংস হচ্ছে। নিজের কুসুমাস্তীর্ণ একটি জীবন দুর্গন্ধময় জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। 

আলোকিত একটি জীবনের সম্ভাবনার বদলে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতে পা বাড়াচ্ছে। তাই আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। পরিবারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ‘অন্যের সন্তান গোল্লায় যাক’ বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। নিজের সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেশে-এসব বিষয়ে তদারকি করতে হবে। পরিবারে শিশু-কিশোরকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় টাকা, ব্যবহারের জিনিস, মোটরসাইকেল প্রভৃতি উপহার দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

একই সঙ্গে সামাজিকভাবেও সতর্ক হতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সমাজভিত্তিক মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, সংস্কৃতিকর্মী, এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সমাজের গণ্যমান্য কয়েকজনকে নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। তারা পাড়া-মহল্লা, খেলার মাঠ, হাটবাজার মনিটরিং করবেন। কোথাও কিশোরদের অনাকাক্সিক্ষত বা সন্দেহজনক জটলা বা একতা দেখলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি বা থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি জীবনও যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। একটি ফুলও যেন অকালে ঝরে না যায়। একটি সম্ভাবনারও যেন অকালমৃত্যু না ঘটে। সেদিকে আমাদের প্রত্যেককে খেয়াল রাখতে হবে।

গণমাধ্যমকর্মী

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close