জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদ-নদীতে সৃষ্ট প্লাবনের সঙ্গে ফসলের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। প্লাবনের সঙ্গে বয়ে আসা পলি জমে উর্বর হয় জমি। বন্যা-পরবর্তী সময়ে মাঠে মাঠে শোভা পায় ফসলের সমারোহ। সোনার ফসল ঘরে তুলে স্বস্তির হাসি হাসেন কৃষক।
তবে এবারে উজানের পাহাড়ি ঢল ও আষাঢ়ের বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট প্লাবন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা পাড়ের ৫৫টি গ্রামের মানুষের জীবনে আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বানের জলে ফসল তলিয়ে নিঃস্ব তারা। বন্যার পানিতে ১ হাজার ৩৯৪ হেক্টর জমির খরিপ ফসল তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৮ হাজার কৃষক। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩ হাজার টন ফসল উৎপাদন কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাশিদুল কবির বলেন, বন্যায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার পর আমরা অধিদফতরে পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে পুনর্বাসন নয়, আমরা বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে সার ও বীজ দিচ্ছি।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি খরিপ-১ মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা নদীতে সৃষ্ট প্লাবনে বেলকা, কাপাসিয়া, হরিপুর, তারাপুর, চণ্ডিপুর, কঞ্চিবাড়ি ও দহবন্দ ইউনিয়নে জলে তলিয়ে গেছে ১ হাজার ৩৯৪ হেক্টর জমির ফসল। এর মধ্যে ৩০ হেক্টর জমির তিল ডুবে গেছে। এতে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০ হেক্টর জমির তিল। আর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ হেক্টর জমির তিল। আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে ৭৭০ হেক্টর জমিতে। আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যথাক্রমে ৫৬০ ও ২১০ হেক্টর জমির আউশ ধান। বানের জলে ডুবে যাওয়া ৬৯ হেক্টর শাকসবজির মধ্যে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪ হেক্টর এবং সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫ হেক্টর।
এ ছাড়া পাট ডুবে গিয়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩৫ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত ১৯০ হেক্টর আমন বীজতলার মধ্যে ২৫ হেক্টর সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬৫ হেক্টর। এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৯২৫ জন কৃষক। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে ২ হাজার ৭০৫ দশমিক ১৫ টন ফসল। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১ হাজার ৫০১ দশমিক ৮২ লাখ টাকা।
সরেজমিন দেখা যায়, বেলকা, কাপাসিয়া, হরিপুর, চণ্ডিপুর ইউনিয়নের চরগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকার পাট, তিল, আউশ, শাকসবজি ও আমন বীজতলা বানের জলে ডুবে গেছে। পানি কিছুটা কমার পর এখন ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিল, শাকসবজি এবং পাট ক্ষেতগুলো। এর মধ্যেই কিছু তিল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন কৃষকরা। পচে যাওয়া তিল তুলে জলের মধ্যেই উঁচু ঢিবি করে রেখে দিয়েছেন। ঢিবি থেকে সেই তিল ভেলা কিংবা নৌকোয় করে পাড়ে তুলতে দেখা যায় কৃষকদের। একটুখানি রোদ উঠলেই সেগুলো শুকাতে দিচ্ছেন কিষানিরা।
কথা হয় উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে কাপাসিয়ার কাজিয়ার চরের মফিজুলের স্ত্রী নীলি বেগমের সঙ্গে। তিল শুকাতে শুকাতে তিনি বলেন, তিন বিঘা জমিতে তিল লাগানো হয়েছিল। আশা ছিল অন্তত ২০ মণ তিল পাব। কিন্তু কপাল খারাপ। বানের পানিতে সব শেষ। কথা বলতে বলতেই নীলি বেগম রোদে শুকাতে দেওয়া তিলগাছগুলো সরিয়ে দেখালেন চটের মধ্যে দুই একটি করে তিল পড়ে আছে।
ভাটিকাপাসিয়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই কৃষক আবদুল কাহার ও ইউনুছ আলী বলেন, হরিপুর, কাপাসিয়া, শ্রীপুরের বাড়াইকান্দি, চণ্ডিপুরের উজান বোচাগাড়ী চরের কৃষকরা প্রতি বছর বন্যা হবে ধরে নিয়েই পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে গাঞ্জিয়া, নাজিরশাইল, বিন্দিপাকড়ি, তিলকাপুড়, ঢ্যাপার মতো স্থানীয় জাতের ধান বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন। শুধু তাই নয়, তিন স্তরের বীজ সংরক্ষণ করি আমরা।
সময়ের আলো/জিকে