ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

নিলাম আয়োজনে কাস্টমসের সময়ক্ষেপণ
কনটেইনারেই নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার ফলমূল
প্রকাশ: শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪, ৫:২৫ এএম  (ভিজিট : ৪৯২)
আমদানিকৃত পণ্য ছাড় করা না হলে কন্দরে তা নিলামে তোলা হয়। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানির পর ছাড় না করা ফলমূল নিলাম আয়োজনে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার পণ্য। নিলাম আয়োজন করলেও ক্রেতা মিলছে না ডলারে আমদানি করা ফলমূলের। পচনশীল পণ্য ৪৫ দিন পার হলেই নিলামে তোলার নিয়ম। তবে ইনভেস্ট্রির নামে কাস্টমসের সময়ক্ষেপণের কারণে ছয় মাসে নিলামে তোলা যায় না। এতে রিফার কনটেইনারের ভেতরেই নষ্ট হচ্ছে বিপুল ফলমূল। যা বাজারে ঘাটতির কারণ হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।

সবশেষ ৮ জুলাই থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত তিনদিন ধরে চলা বৃহত্তম নিলামে আড়াই কোটি টাকার মেন্ডারিন (ছোট আকারের কমলা) বিক্রি হয়নি। কনটেইনারের ভেতর নষ্ট হওয়ায় এসব মেন্ডারিনের কোন ক্রেতাই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতে বিপুল পরিমাণ আমদানি করা মেন্ডারিন ডাম্পিং ইয়ার্ডে নিয়ে ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া বিকল্প নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

নিলাম ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু ইনভেন্ট্রি সময়মতো করা হলে নিলাম আয়োজন দ্রুত করা যেত। এতে পচনশীল পণ্য বিশেষ করে ফলমূল দ্রুত নিলামে তোলা যেত। নিলামে আমদানি পণ্যগুলো বিক্রি করে দেওয়া গেলে বাজারে ফলমূলের সরবরাহ থাকত স্বাভাবিক। কিন্তু ইনভেন্ট্রিতে অহেতুক সময়ক্ষেপণের কারণে আমদানি করা বিপুল ফলমূল কনটেইনারের ভেতরেই নষ্ট হচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া কাস্টমসের বৃহত্তম নিলামে পাঁচ লটভুক্ত অন্তত আড়াই কোটি টাকার মেন্ডারিন পচে গেছে। তাই নিলামে ক্রেতা মেলেনি।

কাস্টমসের সংশ্লিষ্টরা জানান, ইনভেন্ট্রি হচ্ছে লটভুক্ত পণ্যের গুণগত মান সরেজমিন পরীক্ষা করা। ইনভেন্ট্রির মাধ্যমে পণ্যের দাম, মান এবং পরিমাণ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এই ইনভেন্ট্রির জন্য নিলাম শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বা অন্য কর্মকর্তার সমন্বয়ে এক বা একাধিক টিম গঠন করা হয়। যা ইনভেন্ট্রি টিম নামে পরিচিত।


এই টিম ইনভেন্ট্রি শেষে কাস্টমসের নিলাম শাখায় একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিলামের লট তৈরি করা হয়। কাস্টমসের দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পণ্যের নিলাম আয়োজন করে। ইনভেন্ট্রির পর নিশ্চিত হওয়া যায় কোন কনটেইনারে কত পণ্য আছে। এরমধ্যে নিলামযোগ্য পণ্য কতটা আছে তাও নিশ্চিত হওয়া যায়। যেসব কনটেইনার ভর্তি পণ্য পচে নষ্ট হয়ে গেছে সেসব তথ্যও পাওয়া যায় ইনভেন্ট্রিতে। তিন দিনের বড় নিলামের পরও চট্টগ্রাম বন্দরে অকশান ইয়ার্ডে পড়ে আছে শতাধিক পচনশীল পণ্যের কনটেইনার। এসব কনটেইনারে আছে মাল্টা, আপেল, মেন্ডারিনসহ নানা ধরনের ফলমূল। সময়মত নিলাম আয়োজনে ব্যর্থতার কারণে রিফার কনটেইনারের ভেতর আমদানি করা ফলমূল এখন নষ্টের পথে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার মুশফিকুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, বন্দর থেকে নিলামযোগ্য কনটেইনারের 'রিমুভাল লিস্ট' পেতে দেরি হয়। এজন্য নিলাম আয়োজনে দেরি হয়। লিস্ট পাওয়ার পর রিফার কনটেইনারের ইনভেন্ট্রি করতে হয়। রিফার কনটেইনার খালি করার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে রাখতে হয় সব সময়। লোডশেডিংয়ের কারণে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ না হলে রিফার কনটেইনারের পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। আবার দিনের পর দিন বন্দরে পড়ে থাকলে সীমিত সংখ্যক রিফার কনটেইনারগুলোর সঙ্কট দেখা দেয়। তাই এসব কনটেইনার দ্রুত খালি করাও জরুরি।

এম কে করপোরেশন নিলাম আয়োজনে দেরি করে এই অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কমিশন অ্যাজেন্ট হিসাবে এম কে করপোরেশন নিলাম আয়োজনের প্রাথমিক কাজগুলো করে থাকে। কনটেইনারের পণ্য নষ্ট হলে ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুতির কাজটাও তারা করে। বিনিময়ে তারা অল্প পরিমাণ কমিশন পায়। তাদের কোন ধরনের গাফিলতি আছে বলে মনে হয় না।

চট্টগ্রাম কাস্টম নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াকুব চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, সময়মত ইনভেন্ট্রি করতে ব্যর্থ হওয়ায় নিলাম আয়োজন করতে দেরি হচ্ছে। এতে বিদেশ থেকে মার্কিন ডলারে আমদানি করা পণ্য কনটেইনারেই নষ্ট হচ্ছে। জানুয়ারিতে আমদানি করা মেন্ডারিন (ছোট আকারের কমলা যা চাইনিজ কমলা হিসাবে পরিচিত) নিলাম করা হয়েছে চলতি জুলাই মাসে। এসব মেন্ডারিন বিদেশী মুদ্রায় আমদানি করা। ৪৫ দিন পর নিলামে বিক্রি হলে মেন্ডারিন আমদানি বাবদ বিপুল রাজস্ব পেত কাস্টমস। আবার পচনশীল এসব ফলমূল সময়মত বাজারে সরবরাহ হলে ক্রেতারাও কিনতে পারত। কিন্তু কাস্টমস সময়মত নিলাম আয়োজন করতে না পারায় সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
তিনদিনের বৃহত্তম নিলামে কত পণ্য বিক্রি করা যায়নি এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আপেল, মাল্টা, খেজুর বিক্রি করা গেছে। কিন্তু মেন্ডারিন বিক্রি করা যায়নি। নিলামে এসব মেন্ডারিনের কোন ক্রেতাই পাওয়া যায়নি। নিলাম আয়োজনে কাস্টমসের ব্যর্থতায় সর্বশেষ নিলামে পাঁচ লটের অন্তত আড়াই কোটি টাকার মেন্ডারিন কেউ কেনেনি। এসব মেন্ডারিন ডাম্পিং ইয়ার্ডে নিয়ে নষ্ট করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। অথচ এসব মেন্ডারিন নিলামের সময়ের মধ্যে নিলাম হলে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হতো না। ক্রেতারাও স্বল্প দামে মেন্ডারিন কিনতে পারতো।

নিলামে নিয়মিত অংশ নেন রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবছার। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, আমরা বহুবার কাস্টমসের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি পচনশীল পণ্যগুলো নিলাম আয়োজন দ্রুত করতে। কিন্তু নিলাম আয়োজনে দেরি করায় শেষ পর্যন্ত নিলামে আর ক্রেতা পাওয়া যায় না। এতে মূল্যবান ডলারে আমদানি করা পণ্য কনটেইনারের ভেতরেই নষ্ট হচ্ছে। নিলামে পণ্য কেনার ক্রেতার অভাব নেই। কাস্টমসের গাফিলতির কারণে পণ্য নষ্ট হচ্ছে। এক্ষেত্রে নিলাম ব্যবসায়ী বা ক্রেতাদের কোন দায় নেই।
তবে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের নিলাম শাখার কর্মকর্তা মাহবুব রশিদ সময়ের আলোকে বলেন, নিলাম আয়োজন করলেও পণ্য বিক্রি হয়না। ৪০ লাখ টাকার পণ্য ক্রেতারা কিনতে চায় ২০ হাজার টাকায়। তাই কিভাবে নিলামে পণ্য বিক্রি করা যাবে। তার মতে নিলাম আয়োজন করলেও উপযুক্ত দর দেয়ার মতো ক্রেতা না পাওয়ায় নিলামে পণ্য বিক্রি করা যায়না পণ্য।

কাস্টমসের সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে রিফার কনটেইনারে থাকা পণ্য কাস্টমসের গাফিলতিতে প্রতি মাসে নষ্ট হচ্ছে। টাকার অংকে তা কোটি টাকার কম হবে না। নিলামে পণ্য বিক্রি করার চেয়ে ধ্বংস করতে বেশি আগ্রহী কাস্টমস। কে এম করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে নিলাম আয়োজনের। কাস্টমসের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই প্রতিষ্ঠানে নিলাম কার্যক্রম পরিচালনা করে কাস্টমসের অকশান হাউসে। বর্তমানে পচনশীল পণ্যের শতাধিক নিলামযোগ্য কনটেইনার পড়ে আছে। এসব কনটেইনাইর নিলাম আয়োজনে দেরি করায় পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে। কে এম করপোরেশন নিলাম আয়োজনের চেয়ে কনটেইনারের পণ্য ধ্বংস করতে বেশি আগ্রহী। একটি কনটেইনার ভর্তি ধ্বংস করা বাবদ তারা ৪০ হাজার টাকা করে পায়। নিলামে অংশগ্রহনকারীরা সব সময় কাস্টমসের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে সময়মত নিলাম আয়োজন করতে। কিন্তু চক্রের যোগসাজসে নিলাম আয়োজন দেরিতে হয়। তাই শেষ পর্যন্ত বিপুল আমদানি পণ্য কনট্রোরেই নষ্ট হয়।

এ ব্যাপারে কে এম করপোরেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মোরশেদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তাই এই প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিপুল ফলমূল সময়মত ছাড় না করার কারণ হিসাবে নগরীর কদমতলী এলাকার ফলমন্ডির ফল ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানিকারকদের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে তাদের সাথে সাপ্লায়ারের বিভিন্ন ধরনের চুক্তি থাকে। কনটেইনারের পণ্য নষ্ট হলে আমদানিকারক বন্দর থেকে ছাড় নাও করতে পারেন। অনেক সময় আমদানিকারক বুঝতে পারেন কনটেইনারের পচনশীল পণ্যগুলোর বাজার দর কম। ডিউটি
পরিশোধ করে ছাড় করলে তাদের লাভের চেয়ে লস বেশি হবে। তাই কনটেইনার থেকে ফলমূল ছাড় করে না। শেষে এসব পচনশীল পণ্য নিলামে তুলতে হয় বা বিক্রি করতে হয়। নিলামে কেনা ফলের দাম বাজার মূল্যের চেয়ে কম কাস্টমসের অকশান হাউসে তিনদিনের নিলামে বিক্রি হওয়া প্রতি কেজি ফলের দাম পড়েছে বাজার দরের চেয়ে অনেক কম।

প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি হওয়া প্রতি কেজি আপেলের দাম পড়েছে ৪৪ টাকা। বাজারে এসব আপেলের প্রতি কেজি দাম ২শ' টাকার বেশি। এছাড়া কমলার প্রতি কেজি দাম ৬৬ টাকা। প্রতি কেজি খেজুরের দাম পড়েছে ৭৩৬ টাকা। দুটি আইটেমের ফল বর্তমান বাজার মূল্য নিলামে কেনা দামের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন।
৮ জুলাই নিলামে ৪০ লাখ ৭৬ হাজার ১৫৪ টাকা মূল্যের ২৩ হাজার ৪৬২ কেজি বা সাড়ে ২৩ টন কমলা বিক্রি হয়েছে।

এসব কমলা বিক্রি হয় ১৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকায়। ৮৫ লাখ ৪১ হাজার ৮৯৬ টাকা মূল্যের প্রায় ৪৮ মেট্রিক টন লাল আপেল বিক্রি হয়েছে ২৭ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। ৪১ লাখ ২০ হাজার ৯০৭ টাকা মূল্যের সাড়ে ২৩ টন আপেল বিক্রি হয়েছে ১৬ লাখ ৫ হাজার টাকায়। এসব আপেলের প্রতি কেজির দাম
পড়েছে ৬৭ টাকা। ৪১ লাখ ২০ হাজার ৯০৭ টাকা মূল্যের প্রায় ২৪ টন আপেল বিক্রি হয়েছে ১৫ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। বিক্রি হওয়া দাম অনুযায়ী প্রতি কেজির দাম পড়েছে ৬৪ টাকা।

১ কোটি ৮৪ লাখ ১০ হাজার ৯২৪ টাকা মূল্যের ২৫ টন খেজুর 
বিক্রি হয়েছে ৭০ লাখ টাকায়। প্রতি কেজির দাম পড়েছে ৭৩৬ টাকা। সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হন রিয়াজউদ্দিন বাজারের নুরুল আবছার। 

তিনি সময়ের আলোকে বলেন, নিলামে বিক্রি হওয়া খেজুর সবই আমি কিনেছি। আমি সর্বোচ্চ দরদাতা
হওয়ায় আমি কিনতে পেরেছি। ভোক্তা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, রমজানের সময় জেলা প্রশাসন ভোক্তার অভিযানে বিপুল মজুদ খেজুর জব্দ করা হয়েছিল। জরিমানাও করা হয়। কিন্তু বন্দরের অভ্যন্তরে এ সময় রিফার কনটেইনারে আটকে থাকা পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করার মতো আমাদের কোন সুযোগ বা এখতিয়ার নেই। কাস্টমস কর্তৃপক্ষই কেবল রিফার কনটেইনারে আটকে থাকা পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারবে। নিলামে বিক্রি হওয়া পঁচনশীল অনেক পণ্য আমদানি হয়েছে রমজানের সময়।
অথচ বিক্রি না করে এসব কনটেইনারে রেখে দেয়া হয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close