ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ঘাম ঝরিয়েও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চা চাষিরা
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০২৪, ১২:৫৯ এএম  (ভিজিট : ১৭৪)
চা উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল পঞ্চগড় জেলা। কয়েক বছরের চা উৎপাদনে রেকর্ড গড়লেও হাসি ফুটছে না সাধারণ চা চাষিদের মুখে। প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে গুনতে দিশাহারা তারা। গত কয়েক বছরে চা পাতার দাম না থাকা, বিভিন্ন অজুহাতে চা পাতার ওজনে পার্সেন্টেজ কেটে রাখাসহ তাদের বিভিন্ন অভিযোগ চা কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে। কারখানা মালিকদের কাছে যেন জিম্মি হয়ে আছেন চা চাষিরা।

চলতি মৌসুমে দুই দফায় চা পাতার দামে কারখানায় পাতা বিক্রি করছেন চাষিরা। কয়েক দিন আগে পাতার দাম প্রতি কেজি ২২ টাকা পেলেও বর্তমানে ১৭ টাকা কেজি দরে কাঁচা পাতা বিক্রি করছেন চাষিরা। এতে দাম কিছুটা সহনশীলতায় থাকলেও কারখানাগুলো বিভিন্ন অজুহাতে ওজনে শতকরা ২৫ থেকে ৪০ পার্সেন্ট পাতা কেটে নেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। তারা বলছেন, চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কীটনাশক, সার, শ্রমিক, পাতা কর্তনসহ বিভিন্ন খরচের কারণে এমনিতে দাম উঠছে না, তার মধ্যে কারখানাগুলো ইচ্ছেমতো পাতার পার্সেন্টেজ কেটে রেখে পাতা কিনছে। তারা নিরুপায় হয়ে কারখানায় পাতা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। চা পাতার পার্সেন্টেজ কাটার কারণে অনেকেই চা গাছ তুলে ফেলছেন।

সমতলের চায়ের ভরা মৌসুম মে থেকে জুলাই। তবে এপ্রিল থেকেই শুরু হয় পাতা কাটা। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকে পাতা তোলা। এ সময় চাষিরা চা বাগানের পরিচর্যা করে চা পাতা উত্তোলনের উপযোগী করে তোলেন। মৌসুমের শুরুতে চা পাতা নিতে কারখানাগুলো পাতার দাম বাড়িয়ে পাতা কিনলে পরে সিন্ডিকেট তৈরি করে কমিয়ে দেয় পাতার দাম। পাতার চাপ বাড়ানোর জন্য একেক দিন একেক কারখানা বন্ধ রেখে কমিয়ে দেওয়া হয় দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি চা পাতা ১৭ টাকা দরে কিনলেও মোট ওজন থেকে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে পাতা কিনছে। এতে চাষিরা চা পাতা কারখানায় নিয়ে প্রায় অর্ধেক হারাচ্ছেন ওজনে। পাচ্ছেন প্রকৃত দামের অর্ধেক। এ কারণে পাতার দাম থাকলেও লোকসানে পড়তে হচ্ছে চাষিদের।

অথচ চাষিদের কাছ থেকে কম দামে এবং ওজন বাদ দিয়ে নেওয়া চা থেকে দৈনিক কোটি টাকা ঢুকছে কারখানা মালিকদের পকেটে। চা বাগান ঘিরে কারখানার পরিধি বাড়লেও দাম বাড়েনি চাষিদের পাতার। বিভিন্ন সিন্ডিকেট তৈরি করে অনেক কারখানা মালিক চাষিদের কাছ থেকে বাগান কিনে নিচ্ছেন। সমতলের ক্ষুদ্র চা চাষিদের ঘামঝরা চা চাষে পকেট ভরছে কারখানা মালিকদের।

চলতি বছরের ২৯ মে নিলাম ছাড়াই উৎপাদিত চা অবৈধপথে কুরিয়ারের মাধ্যমে বিক্রির চেষ্টায় ৫০০ বস্তা চা জব্দ করেছে চা বোর্ড। গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে পাচারের সময় চা-ভর্তি অর্ধশতাধিক বস্তাসহ একটি পিকআপ জব্দ করে সদর থানা পুলিশ। এর আগে ২০২২ সালের ২২ আগস্ট রাতে পঞ্চগড় জেলা শহরের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন রোডের সদাগর এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে ২১২ বস্তা চা জব্দ করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে চলছে ভরা মৌসুমে চায়ের কৃত্রিম সংকট। জেলা প্রশাসন টাস্ক ফোর্স গঠন, মনিটরিং টিম গঠন করলেও দুয়েকটি কারখানায় নামমাত্র জরিমানা করা ছাড়া কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কারখানা মালিকদের এ দৌরাত্ম্যকে অনেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করছেন।

চা পাতার দাম না পেলেও উৎপাদনে রেকর্ড গড়ছেন চাষিরা। টানা তৃতীয়বার চা উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থান দখলে রেখেছে উত্তরাঞ্চল। চলতি মৌসুমে জাতীয় উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে ১৭ শতাংশ চা। সিলেট ও পার্বত্যাঞ্চলের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২০২৩ সালে রেকর্ড ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৪০ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়েছে। গত ২০২২ মৌসুমে চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৬৮ কেজি। এ হিসাবে ২০২২ সালের চেয়ে চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৬৫ হাজার কেজি বেশি উৎপাদন হয়েছে। এর আগের ২০২১ মৌসুমে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার কেজি সবুজ চা পাতা উত্তোলনের মাধ্যমে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়, যা বাংলাদেশে জাতীয় উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। চা শিল্প ঘিরে এ জেলায় ২৭টি চা কারখানা গড়ে উঠেছে। চা উৎপাদনে টানা রেকর্ড হলেও চাষিদের কাঁচা চা পাতার দাম না পাওয়া, সিন্ডিকেট তৈরি করে কর্তন করে পুঁজিবাদীদের পকেট ভরলেও চরম হতাশায় গত দুই বছরে অনেকে চা বাগান উঠিয়ে ভিন্ন আবাদের দিকে ছুটছেন।

চাষিদের চা পাতার ন্যায্যমূল্য পেতে ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর এ জেলায় দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় সরকার। এর ফলে গত বছর ২ সেপ্টেম্বর নিলামকেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন। পরের মাস অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জেলায় প্রথম অনলাইনে চা নিলাম কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রথম নিলামে প্রতি কেজি চা বিক্রি হয়েছিল ২১২ টাকা দরে। এ চা নিলামকেন্দ্র চালুতে চাষিরা উৎপাদিত চা পাতার ন্যায্যমূল্য পাওয়ার স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবায়নের পথ দেখছেন না তারা।

হিমু, আবদুল করিম ও নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন চা চাষি জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ১৭ টাকা দরে বিক্রি হলেও কারখানা মালিকরা ওজন থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে পাতা বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। আমরা কষ্ট করে চা আবাদ করি আর কারখানা মালিকরা বিনাশ্রমে অর্ধেক চা নিয়ে নেয়। তারা চাষিদের মানুষ মনে করে না। বর্তমানে চা পাতা বিক্রি করে যে টাকা 
পাচ্ছি তা দিয়ে কামলা খরচ আর পথ খরচই ওঠে না। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চা বাগান পরিচর্যা করতে হয়েছে। অনেক সময় এনজিওর লোক ঋণের কিস্তির জন্য বাড়িতে বসে থাকে। কিস্তির টাকা দিতে পারি না। সার, কীটনাশকের দোকানে বাকির টাকাও পরিশোধ করতে পারছি না। এ রকম অভিযোগ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার অনেক ক্ষুদ্র চা চাষির।

পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলায় এখন পর্যন্ত ৯টি নিবন্ধিত ও ২১টি অনিবন্ধিত বড় চা বাগান (২৫ একরের বেশি) রয়েছে। এ ছাড়াও ছোট ছোট চা বাগান রয়েছে ৮ হাজার ৩৫৫টি। এ নিয়ে উত্তরের ৫ জেলায় ১২ হাজার ৭৯ একর সমতল ভূমিতে চা চাষ হচ্ছে এবং এসব চা বাগানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮ হাজার শ্রমিকের।

তেঁতুলিয়া গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেডের ম্যানেজার মো. মঞ্জুর আলম (মঞ্জু) জানান, আমাদের কারখানায় চা পাতা বিক্রি করতে এসে ৩০-৪০ পার্সেন্ট কাটা হয়েছে এ রকম কোনো অভিযোগ নেই। তবে বৃষ্টির সময় ভেজা পাতার কারণে ১০-১৫ শতাংশ কাটা হয়। আমাদের কারখানার নির্দিষ্ট করা চা চাষি রয়েছেন, তারা নিয়মিত পাতা দিচ্ছেন। একই কথা বলেন তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপক মতিয়ার রহমান।

তেঁতুলিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন খান বলেন, এখানকার চা চাষিদের কাছ থেকে শুনছি তারা কারখানা চা পাতা বিক্রি করতে গেলে কারখানা কর্তৃপক্ষ ৩০-৪০ শতাংশ কেটে নিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলার পরেও তারা শুনছেন না। এখন বিষয়টি আমরা এমপি মহোদয়কে জানিয়েছি।

চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, কারখানা মালিকরা চা চাষিদের কাছ থেকে চা পাতা কর্তন করে নেওয়ার অভিযোগ শুনেছি। বিষয়টি আমরা পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুজ্জামান ভূঁইয়া মুক্তার সঙ্গে কথা বলেছি। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসক, চা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। আশা করছি তারা ব্যবস্থা নেবেন।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কাঁচা চা পাতার কম দাম ও কর্তন করার অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। শিগগিরই চা-সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close