১৩-১৪ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল রাজিয়া মাসুদকে। পড়েছেন এইচএসসি পর্যন্ত। বেশি লেখাপড়া করতে না পারার কষ্ট বুকে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। আর সেই আকাঙ্কা থেকেই তার চার সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তাদের মানুষ করে হয়েছেন রত্নগর্ভা ‘মা’।
২০১৮ সালে রাজিয়া মাসুদ সফল জননী হিসেবে হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে জয়িতা নির্বাচিত হন। পরে ২০১৯ সালের ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এ স্বীকৃতির সম্মাননা পুরস্কার তুলে দেন।
রাজিয়া মাসুদের জন্ম ১৯৬৩ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত রাজিয়া মাসুদ ১৯৮৩ সাল থেকে উপজেলার নানুপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নারী সদস্য হিসেবে তিন যুগ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে ফটিকছড়ি উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান তিনি।
বিয়ের পর স্বাধীনতা-পরবর্তী অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন রাজিয়া। রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে তার বর মিথ্যা মামলায় জেলে গেলে আর্থিক ও মানসিক কষ্টে পড়েন তিনি। শত অভাবেও রাজিয়া ভেঙে পড়েননি। তিনি উপজেলা সমাজসেবা অধিদফতর থেকে তিন হাজার টাকার ঋণে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। সেখান থেকে অর্জিত অর্থে নিজে পানি খেয়ে সন্তানদের পান্তা ভাতের থালা তুলে দিতেন। এভাবেই খেয়ে না খেয়ে তিনি সন্তানদের বড় করেছেন। রাজিয়া মাসুদ এখনও বাসার সব কাজকর্ম করেন নিজের হাতে। কাজ শেষে নাতি-নাতনির সঙ্গে করেন খুনসুটি। তিনি উপজেলার মাইজভান্ডার গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবু তাহের মাসুদের স্ত্রী।
সংগ্রামী মা রাজিয়া মাসুদ বলেন, ‘সংসারে দারুণ অভাব ছিল। বর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে অবহেলার পাত্র ছিলাম তখন। চার সন্তান নিয়ে আমি তখন অথৈ সাগরে। কখনো ভেঙে পড়িনি। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করেই তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না, তবে সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত এটাই আমার গর্ব।’
রাজিয়া মাসুদের দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে সবাই স্নাতকোত্তর। বড় ছেলে আরমান আল মাসুদ বাংলাদেশ পুলিশ হেডকায়ার্টারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে কর্মরত। ছোট ছেলে মামুন আল মাসুদ স্নাতকোত্তর শেষে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বড় মেয়ে মুনতাসির জাহান চট্টগ্রাম সরকারি আবাসন পরিদফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর। ছোট মেয়ে তামান্না তাসনিম মাসুদ স্নাতকোত্তর শেষে চট্টগ্রামের একটি ফ্যাশন ডিজাইন প্রতিষ্ঠানে প্রধান হিসেবে কর্মরত।
রত্নগর্ভা মা রাজিয়া মাসুদ বলেন, ‘জীবনের সব ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছি। সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়েছি। সন্তানদের বলেছি, জীবনে অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে। সমাজের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।’ কঠিন সময়ে ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনো কাজে সদিচ্ছা, সততা, স্বচ্ছতা ও চেষ্টা থাকলে সফল হবেই। কারো প্রতি নির্ভর না করে নিজেকেই গোছাতে হবে। সফল হতে হলে এটাই হচ্ছে মূলমন্ত্র।’
রাজিয়া মাসুদের বড় ছেলে আরমান আল মাসুদ বলেন, ‘মা আমাদের আদর্শ। মায়ের অনুপ্রেরণাতেই আমরা সবাই উচ্চশিক্ষিত হয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সব কাজকর্ম একা হাতে করেও তিনি সবসময় আমাদের লেখাপড়ার তদারকি করতেন। আল্লাহ আমার মাসহ সব মাকে ভালো রাখুন।’
বড় মেয়ে মুনতাসির জাহান বলেন, ‘মা সব বাধা পেরিয়ে একজন সফল নারী। আমাদের শিক্ষিত করতে গিয়ে গ্রামের মানুষের কাছে তাকে শুনতে হয়েছে নানা কটু কথা। তারপরও তিনি থেমে যাননি। সবকিছু উপেক্ষা করেছেন।’
রাজিয়া মাসুদের বর মোহাম্মদ আবু তাহের মাসুদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পেশায় পল্লীচিকিৎসক হলেও তিনি একজন প্রকৃতিপ্রেমী। তিনি বলেন, ‘সর্বাবস্থায় চেয়েছি সন্তানদের মানুষ করতে। স্রষ্টা আমার আশা পূরণ করেছেন। এটাই আমার জন্য বড় গর্বের। বড় আনন্দের।’
সময়ের আলো/আরএস/