ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

জলবায়ু, স্থাপত্য ও জীবন
প্রকাশ: শনিবার, ১৫ জুন, ২০২৪, ১:৫২ এএম  (ভিজিট : ৪৩৮)
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়াটি একটি দীর্ঘ সময়কাল ধরে চলে আসতে আসতে আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সেই ১৯ শতকের গোড়া থেকে অর্থাৎ প্রাক-শিল্পযুগের সময় থেকে এই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় যার মূল কারণ ছিল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের সৃষ্টি। উন্নয়নের ধারা যেমন থেমে থাকেনি, থেমে থাকেনি কলকারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, অফিস-বাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রকের ব্যবহার তেমনি থেমে থাকেনি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়াও। 

বলা হচ্ছে বিশ্ব এখন ষষ্ঠ গণ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যার পেছনে আছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মানুষের অযাচিত ও অন্যায় হস্তক্ষেপ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনের মতো দুটি প্রধান কারণ। নানা কারণে মানুষ প্রকৃতির ওপর যে চাপ প্রয়োগ  করেছে তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে আবহাওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য, মানুষ, প্রাণীকুল ও বৃক্ষরাজির ওপর। একে একে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণী, পাখি, মাছ ও বৃক্ষ। সাম্প্রতিককালে মরু শহর দুবাইয়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টি ও বন্যাই বলে দিচ্ছে ভালো নেই আমাদের ধরিত্রীমাতা।

সেই প্রাক-শিল্পযুগ থেকে পৃথিবী প্রতি বছর ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে উষ্ণতর হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ধারাবাহিক ও অবধারিত ফলই হলো জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বেড়েছে, বেড়েছে রোগবালাই, মহামারিও। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর্যুপরি ব্যবহার, যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র থেকে নির্গত উষ্ণবায়ু সরাসরি আমাদের বায়ুমণ্ডলে চলে যাচ্ছে যা প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। নগরায়ণ ও শিল্পায়ন বৃদ্ধির ফলে ব্যাপকহারে বেড়েছে বৃক্ষনিধন। 

বেড়েছে জলাশয় ভরাট করার মতো ঘটনাও। বন-জঙ্গল, কৃষিজমি, নদী-নালা, খাল-বিল উজাড় করে মানুষ গড়ে তুলছে নগর। বিশ্ব যত নগরায়ণের দিকে ঝুঁকছে তত বেড়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপও। গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহে পুড়ে যাবে চারপাশ-এটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক দিনের তাপপ্রবাহের ফলে গ্রীষ্মের গরম টের পাচ্ছে সবাই হাড়ে হাড়ে। তবে আমাদের ছেলেবেলার গ্রীষ্মকালের সঙ্গে বর্তমান সময়ের গ্রীষ্মকালের পার্থক্য অনেক। গরমের ধরন বদলে গেছে আমূল। গ্রীষ্ম প্রলম্বিত হচ্ছে, বর্ষা বিলম্বিত ও সংক্ষিপ্ত। শীতকালেও সেভাবে ঠান্ডা পড়ে না, বসন্ত আর শরৎও হারিয়েছে তাদের স্বকীয়তা। আবার মাঝেমধ্যে অসময়ের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম, দেখা দেয় বন্যা। এমন নয় যে শুধু আমাদের দেশেই এমনটা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে সব দেশেরই জলবায়ুর প্রকৃতিতে এসেছে পরিবর্তন।

বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের জন্য অন্যতম দায়ী রাষ্ট্র হলো-আমেরিকা, চীন ও ভারত। জাতিসংঘের তথ্য মোতাবেক, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ নগরাঞ্চলে বসবাস করবে। নিঃসন্দেহে জলবায়ু পরিবর্তনের হার আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন হয়ে উঠবে হুমকির সম্মুখীন। আমরা কোনোভাবে টিকে যাচ্ছি, তারা কীভাবে জলবায়ুর এ বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করবে তা যারপরনাই শঙ্কার বিষয়। তাই পৃথিবী আজ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্বাস্থ্য, শিল্প, শিক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনা-এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এর পরিবর্তনের প্রভাব পড়েনি। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কতটা আছে তা বলা মুশকিল, তবে প্রশমনের উপায় অবশ্যই আছে। 

শিল্পায়নের পাশাপাশি স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনাও অনেকাংশে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। বলা হয় বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী নির্মাণ খাত তথা স্থাপত্য। স্থাপত্যে ভবন নকশার সর্বজনীন মাপকাঠিগুলো ভবনের কাঠামো, পরিকল্পনা ইত্যাদির মাঝে সীমাবদ্ধ। স্থাপত্যের মূল বিষয় হলো-পরিবেশের সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে এবং নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যতা। শীতপ্রধান অঞ্চলের ভবন আর গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের ভবনের নকশায় পার্থক্য থাকে। 

আজকাল বিশ্বব্যাপী কাচেঘেরা ভবনের কদর বেড়েছে বহুলাংশে। পিছিয়ে নেই আমাদের দেশও। ঢাকাসহ বিভাগীয় সব শহরে সুউচ্চ অফিস ভবন, বাসস্থান ও বিপণিকেন্দ্রগুলো কাচেঘেরা থাকে। যা আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের জন্য একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এর ফলে যেমন ভবনের ভেতরকার তাপমাত্রা বাড়ছে তেমনি বেড়ে যাচ্ছে আশপাশের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাও। কারণ খুব স্বাভাবিকভাবেই ভবনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে আরামদায়ক রাখার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হচ্ছে। অথচ একটু খেয়াল রাখলেই ভবনগুলোতে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব হতো। 

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সৌর ও জল বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতাকে অনুধাবন করতে হবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে, নীতি নির্ধারকদের তো বটেই। না হলে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় থাকবে না। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমাদের শহর ও গ্রামগুলোকে যথাক্রমে স্মার্ট শহর ও স্মার্ট গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলার কথা বলা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য সুরক্ষা, স্মার্ট যোগাযোগ, স্মার্ট ইউটিলিটি, স্মার্ট জন নিরাপত্তা, স্মার্ট নগর প্রশাসন, স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে। 

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমন করার উপায় আছে। তার একটি বড় সমাধান করা যাবে নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের মাধ্যমে। নগরগুলোকে গড়ে তুলতে হবে টেকসই করে যেখানে ভবনগুলোতে যান্ত্রিক তাপ নিয়ন্ত্রকের ওপর নির্ভরতা কমবে, মানুষের যানবাহনের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে অনেকাংশে যার ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ। থাকতে হবে উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ, আইন ও বিধিমালা যার ফলে নিষিদ্ধ হবে নগরায়ণের নামে অবাধে বৃক্ষনিধন, জলাশয় ভরাট ও কৃষিজমির বিনাশ। প্রয়োজনে আইন করে ভবনে ঢালাও কাচের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সবুজ স্থাপত্য চর্চা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close