ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

রঙিলা ফল
দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে
প্রকাশ: শুক্রবার, ৭ জুন, ২০২৪, ৩:১২ এএম  (ভিজিট : ১০৩৬)
কাঁঠালের চটপটে ভর্তার স্বাদ অনেকের জিহ্বায় লেগে থাকার কথা। কাঁঠালের মাঝখানে মোটা দণ্ড, যাকে আমরা মোচা বলি, এটিও অনেকের কাছে মজার খাদ্য হিসেবে পাতে ওঠে। বেগুন ভর্তার মতো এটা দিয়ে চমৎকার এবং মুখরোচক ভর্তা বানানো হয়। কাঁচা কাঁঠালের কাবাব একেবারে মাংসের কাবাবের স্বাদের মতো হয়। না জানিয়ে পরিবেশন করলে অনেকেই পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন না যে এটা মাংসের কাবাব না কাঁচা কাঁঠালের কাবাব। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে বাঙালির অবস্থা যখন হাঁসফাঁস তখনও এই মানুষেরা মধুমাস কথাটি ভোলে না। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতুর শুরু বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে অর্থাৎ গ্রীষ্মের মাধ্যমে। আম, জাম, লিচু, কাঁঠালে ভরপুর, মানে মধুরসে টইটম্বুর। আর এই রসের ভিড়ে সবচেয়ে রসালো ফলটির নাম কী? খুব কি কঠিন প্রশ্ন? মোটেই না। সবচেয়ে রসালো এবং সহজ ফলই কাঁঠাল, যা আমাদের জাতীয় ফল। কাঁঠালের বৈজ্ঞানিক নাম ‘আর্টোকার্পাস হেটেরোফাইলাস’।
কাঁঠালের মূল উৎস কোথায় তা নিশ্চিত করে না বলা গেলেও ধারণা করা হয় এই ফলটি সম্ভবত ভারতের পশ্চিমঘাট অঞ্চলের এবং এই ফলটি প্রথম চাষ করা ফলগুলোর মধ্যে একটি। অর্থাৎ কাঁঠাল আমাদের এই উপমহাদেশীয় ফল। প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণে অন্যান্য অনেক গাছের সঙ্গে কাঁঠাল গাছের উল্লেখ রয়েছে, তবে তা ‘কাঁঠাল’ নামে নয়, ‘পনস’ হিসেবে। কাঁঠালের ঔষধি গুণের কথা মাথায় রেখেই নাম ‘পনস’ হয়েছে। ‘পনস’-এর অর্থ হলো দূর করা বা তাড়িয়ে দেওয়া। তবে এই রচনা ‘পনস’ নিয়ে না, বরং কাঁঠাল নিয়ে। কাঁঠাল উৎপাদনে ভারত প্রথম এবং তারপরেই বাংলাদেশের স্থান।
কাঁঠাল নামকরণেও এক চমৎকার যুক্তি পাওয়া যায়। জানা যায়, প্রাচীনকালে এর নাম ছিল ‘কন্টকি ফল’। অনুমান করা যায়, যেহেতু কাঁঠালের সারা শরীর কাঁটার মতো, তাই এর নাম হয়েছিল ‘কন্টকি ফল’। কন্টকি ফল কথাটাই কালক্রমে ‘কাঁঠাল’ হয়ে বিবর্তিত হতে হতে ‘কাঁঠাল’ হয়ে যায়। কাঁঠাল দীর্ঘজীবী গাছ, এমনকি ১০০ বছরও টিকে থাকতে পারে। কাঁঠাল একটি বহুমুখী প্রতিভাধর ফল। কাঁঠাল নিয়ে যেমন খাদ্যরসিকদের আগ্রহের শেষ নেই, তেমনি হাস্যরসিকদের আগ্রহেরও শেষ নেই। কাঁঠাল নিয়ে রয়েছে গান, কবিতা, গল্প এমনকি প্রবাদবাক্যও।
খাদ্যরসিকরা আবিষ্কার করতে করতে কাঁঠালের বিচির ডালও আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এ ছাড়া শুঁটকি দিয়ে কাঁঠালের বিচি রান্না বাঙালির মুখরোচক খাদ্য। অনেকেই পেঁয়াজ-মরিচসহ কাঁঠালের বিচির ভর্তা তৈরি করেন যা কাঁঠালের মৌসুমে বাঙালির অনেকের ঘরেই দেখা যায়। গরু এবং মুরগির মাংস দিয়ে কাঁঠালের বিচি তো অহরহ প্রতিটি বাড়িতে রান্না করা হয়। 
কাঁঠালের মাঝখানে মোটা দণ্ড, যাকে আমরা মোচা বা ভুতি বলি, এটিও অনেকের কাছে মজার খাদ্য হিসেবে পাতে ওঠে। বেগুন ভর্তার মতো এটি দিয়ে চমৎকার এবং মুখরোচক ভর্তা বানানো হয়। কাঁচা কাঁঠালের কাবাব একেবারে মাংসের কাবাবের স্বাদের মতো হয়। না জানিয়ে পরিবেশন করলে অনেকেই পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন না যে এটা মাংসের কাবাব না কাঁচা কাঁঠালের কাবাব। কাঁঠালের মাংসের মতো ব্যবহার দেখেই সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এর নাম দিয়েছেন ‘গাছপাঁঠা।’ কিছুদিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাংসের বদলে কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে বার্গার, রোল, কাবাব তৈরির কথা বলেছিলেন। আমার কাছেও তাঁর পরামর্শ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। ইউটিউবে খুঁজলে কাঁঠালের ১২৬ প্রকার পদের খোঁজ পাওয়া যায়। ভোজনরসিক বাঙালি বলে কথা! কাঁঠাল নিয়ে রয়েছে মজার মজার প্রচলিত প্রবাদবাক্য, ধাঁধা এবং বাগ্্ধারা। 
সবচেয়ে প্রচলিত বাক্যটি হলো- ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ অর্থাৎ কোনো বিষয় এখনও কিছুই হয়নি কিন্তু আশা মানুষকে জাগিয়ে রেখেছে। আবার বাঙালির খুবই প্রচলিত বাক্য হলো- ‘পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া’; এক কথায় বলা যায় ‘স্বার্থ উদ্ধার’। অনেকেই গাছ থেকে কাঁচা কাঁঠাল পেড়ে বোঁটায় লোহা গুঁজে দিয়ে কাঁঠাল পাকায়। এই অর্থেই এসেছে ‘কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো’। আবার অসম্ভব অবাস্তব কোনো বস্তুকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয় ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ 
কথাটি। বরিশাল অঞ্চলে কাঁঠাল নিয়ে চমৎকার ধাঁধা রয়েছে- ‘উপরে কাডা ভিত্তে আডা, এই শিল্লুক যে না ভাঙাইতে পারে, হে উত্তইরা পাঁডা।’ বরিশাল হলো বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে। উত্তরইরা পাঁডা হলো উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারীরা, আর শ্লোকের উত্তর হলো ‘কাঁঠাল’।
কাঁঠাল নিয়ে স্থানভেদেও অনেক প্রবাদবাক্য রয়েছে, যেমন- চব্বিশ পরগনার প্রবাদ ‘বনের ভেতর থে বেরল হুমো/ হুমোর গায়ে সাতশ ডুমো।’ কিংবা ‘এ পাড়ার বুড়ি মরল,/ ও পাড়ায় গন্ধ পেল।’ রংপুরের প্রবাদ ‘তেল চুকচুক পাতা, ফলের ওপর কাঁটা/ পাকলে হয় মধুর মতো, বিচি গোটা গোটা।’ কিংবা ‘মুলাকার বীর তার সর্বগায় শিঙ/ দেড় বুড়ি অন্ত তার এক গোটা লিঙ।’ আবার জলপাইগুড়ির প্রবাদ- ‘একনা বুড়ি/ সারা গায়ে ফুসুরি।’
সাহিত্যেও রয়েছে কাঁঠালের সরব উপস্থিতি। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’তে কাঁঠাল গাছকে এনেছেন মায়াময় ছায়াবৃক্ষ হিসেবে। তিনি লিখেছেন : ‘কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়’ কিংবা ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও’ কবিতায় তিনি লিখেছেন : ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে/ রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে...। কিংবা শাহাদুজ্জামান তার ‘কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলা’র ছোটগল্পে লিখেছেন : ‘কী করে কে জানে একদিন এক কাঁঠাল পাতা ও মাটির ঢেলার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল...।’ শরৎচন্দ্রের উপন্যাস শ্রীকান্তের একটি চরিত্র আফিমখোর ভট্টাচার্য মার খেয়ে বলছে, ‘খোট্টা ব্যাটারা কিলায়কে কাঁঠাল পাকায় দিয়া!’
শুধুই কি কবিতা আর গল্প, কাঁঠাল নিয়ে রয়েছে পূর্ণ দাস বাউলের মজার লোকগান, এই যেমন- ‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে জোড়া ছাড়বে না ভাই।’
কাঁঠাল নিয়ে রয়েছে মজার চুটকি, যেমন- একবার ফলবিষয়ক এক কমিটি থেকে জানতে চাওয়া হলো আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল কোন লিঙ্গ? অনেক গবেষণার পরও যখন কেউ কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারল না, তখন সবাই মিলে এক বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইল-কাঁঠাল কোন লিঙ্গ। বিশেষজ্ঞ মুচকি হেসে বললেন- এ তো খুবই সহজ! কাঁঠাল পুংলিঙ্গ, কারণ এর বিচি আছে। কিংবা সেই বিখ্যাত চুটকির কথা বলা যায়, যখন এক পাঞ্জাবি সৈন্য কাঁঠাল খেয়ে কাঁঠালের আঠায় দাড়ি-মোছ ভরিয়ে ক্লিন সেভ করতে বাধ্য হওয়ার পর, ক্লিন সেভ করা যাকেই দেখছিল তাকেই জিজ্ঞেস করছিল, ‘হাম কাঁঠাল খায়া, তুমভি কাঁঠাল খায়া।’ কাঁঠাল দিয়ে একটি মিষ্টি গালি রয়েছে। হ্যাঁ মিষ্টিই। কারণ কোনো বাচ্চা যদি কম বয়সে বেশি বোঝে, তাকে আমরা বলি ‘ইঁচড়েপাকা’। ‘ইঁচড়’ মানে মুচি কাঁঠাল। কাঁঠাল মূলত একটি উভলিঙ্গ গাছ। কাঁঠালের স্ত্রীফুল কাণ্ডের গোড়ার দিকে আর পুরুষফুল কাণ্ডের গোড়া ও উপর দুই দিকেই হয়। এগুলোকে মঞ্জরি বলে। এ মঞ্জরিগুলোই আসলে কাঁঠালের মুচি বা ‘এঁচোড়’। ছোটরা বড়দের মতো কাজকর্ম করলে যে ‘ইঁচড়েপাকা’ কথাটা বলা হয় তা এই ‘মুচি বা মঞ্জরি’ থেকেই এসেছে। এই মুচি কখনোই বড় হয় না বা পূর্ণ কাঁঠাল হয় না, ছোট থাকতেই পরিপক্ব হয়ে যায়। কাঁচামরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে এর চটপটে ভর্তার স্বাদ অনেকের জিহ্বায় লেগে থাকার কথা।
কাঁঠাল নিয়ে অনেক কথা হলো, এবার একটু জরুরি 
কথাও বলা যাক। উপকারিতা আর ‘কাঁঠাল ও কাঁঠাল গাছ’ পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। এর ফল, ফুল, কাঠ, এমনকি দুধকষ বা আঠা, শিকড়ও কাজে লাগে যা সর্বজনবিদিত।
কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হলো ‘ভিটামিন-সি’ যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধে ভীষণভাবে সহায়ক। এর পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপে কাজ করে এবং এর ভিটামিন-এ বাচ্চাদের রাতকানা রোগে উপকারী। কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস একটি চমৎকার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা বাহ্যিকভাবে বার্ধক্য রোধ করে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। কাঁঠাল থেকে যে উৎকৃষ্ট পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায় তা হাঁপানির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এবং চর্মরোগে জ্বর ও ডায়রিয়ায় কার্যকর। কাঁঠালে বিদ্যমান ভিটামিন বি-৬ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। কাঁঠাল আঁশযুক্ত ফল বিধায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। 
কাঁঠালের সঙ্গে ধনী-দরিদ্র বিষয়টিও জড়িত। কাঁঠালের ভক্ষণ প্রক্রিয়ার কারণে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পাতে কাঁঠাল খুব কমই দেখা যায়। অনেক অর্থকড়িওয়ালা কাঁঠালকে গরিবের ফল বলেও টিটকারি করে। 
এর প্রধান কারণ হলো, একটি কাঁঠাল ও মুড়ি থাকলে তিন-চার সদস্যের একটি পরিবার তিন বেলা এই একই খাদ্য দিয়ে অনায়াসে চালিয়ে দিতে পারে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close