ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

আগামীর পৃথিবী চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর
প্রকাশ: বুধবার, ৫ জুন, ২০২৪, ১:৫৭ এএম আপডেট: ০৫.০৬.২০২৪ ৭:৫১ এএম  (ভিজিট : ৩৯১)
আমাদের দেশ গ্রীষ্মপ্রধান। বছরের একটা বড় সময় তীব্র রোদ ও ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়। আজকাল পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও ভবনে কাচের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। যার ফলে বাইরের তাপকে আমরা অনেকটাই ঘরের ভেতরে টেনে আনছি। এতে করে যান্ত্রিক সমাধানের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। চতুর্দিকে ঢালাওভাবে কাচের ব্যবহার ভবনের তাপমাত্রাকে এমনভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে যে, এয়ার কন্ডিশনারের ওপর নির্ভর করতেই হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, নগরাঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত এক দশকে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। 

অতীতে আমাদের অফিস ভবনগুলোতে এসির ব্যবহার ছিল নিয়ন্ত্রিত। কারণ সেখানে প্রাকৃতিক আলো হাওয়া চলাচলের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা হতো। আমাদের আবহাওয়ার যা ধরন তাতে বাতাসের নির্বিঘ্ন চলাচলই আমাদের আরামদায়ক ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে যেসব ঘরবাড়ি তৈরি করা হয় তা একেক অঞ্চলের আবহাওয়াভেদে একেকরকম। সেসব ঘরের কোনোটিতেই অসহ্য গরম বা শীত অনুভূত হয় না, এর মূল কারণ হলো প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য যা আমাদের নগরাঞ্চলের বর্তমান ভবনগুলোতে অনুপস্থিত। উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিমের এ বিষয়টি মেনে চললে খুব সহজেই এসির ব্যবহার কমিয়ে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারি তেমনি অন্যদিকে পরিবেশকে এসির ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও রক্ষা করতে পারি। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে আমরা তাপমাত্রাকে যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ যত বেশি হ্রাস করতে পারব ততই আমাদের জন্য  সর্বোপরি এ পৃথিবীর জন্যে মঙ্গল। 

আবার বছরের একটা বড় সময় আমরা বৃষ্টির পানি পাই। ভরা বর্ষার মৌসুমে এ পানি দূষণমুক্ত থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশিরভাগ পানিই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে নোংরা ও দূষিত পানির সাথে মিশে নদীতে গিয়ে পড়ে। অথচ খুব সহজেই প্রতিটি বাড়ির ছাদে বা গ্যারেজে আমরা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে পারি। এতে করে পরবর্তীকালে এ পানি ব্যবহার করে নগর অবকাঠামোর ওপর চাপ কমিয়ে আনা যায়। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও এমনভাবে তৈরি করা উচিত যাতে দূষিত পানি নদীনালায় সরাসরি না গিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশে ‘ফিকাল স্ল্যাজ ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ নীতি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশেও সেই চর্চা শুরু হচ্ছে ধীরে ধীরে। 

পুরনো ভবনের নির্মাণসামগ্রীর পুনঃব্যবহারও সবুজ স্থাপত্যের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য। এতে করে আবর্জনার পরিমাণ কমে যায় অনেকটাই। আবার উন্নত বিশ্বে অনেক ভবনেই রান্নাঘরের আবর্জনা থেকে প্রাকৃতিক সার তৈরির ব্যবস্থা থাকে। আবর্জনা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহারের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়।
 
‘সবুজ স্থাপত্য’ বা ‘গ্রিন আর্কিটেকচার’ বর্তমানকালে বিশ্বব্যাপী একটি বহুল আলোচিত বিষয়। ‘সবুজ স্থাপত্য’ নামটি প্রথমে শুনলে মনে হতে পারে এর সঙ্গে শুধুই গাছপালা আর সবুজের সম্পর্ক। মূলত ‘সবুজ’ এখানে একটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি ভবন বা স্থাপনায় গাছের আধিক্য মানেই সবুজ স্থাপত্য-এ ধারণাও অনেকে পোষণ করে থাকেন। আদতে তা একেবারেই নয়। ‘গ্রিন আর্কিটেকচার’ বা ‘সবুজ স্থাপত্য’র সঙ্গে ‘টেকসই’ বা ‘সাসটেইনেবল’ এবং ‘পরিবেশবান্ধব’ শব্দ দুটি বেশি সম্পর্কিত। 

আবার আপনার বাড়ির অন্দরসজ্জাও এমনভাবে করা যেতে পারে যাতে গৃহাভ্যন্তরের পরিবেশ হবে টেকসই ও স্বাস্থ্যকর। সবুজ স্থাপত্যের সহজ উদাহরণ হিসেবে আমরা উপরোক্ত আলোচনাকে বিবেচনা করতে পারি।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা, এগিয়ে চলেছে আমাদের নগরগুলোও। নগরায়ণের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ভবন নির্মাণ। নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও ‘টেকসই’ নগর নির্মাণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নগরের ক্ষেত্রে ‘টেকসই’ পরিকল্পনা থাকলে তার স্থাপনাগুলোও টেকসই হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে ‘সবুজ নগর পরিকল্পনা’ বা ‘সবুজ স্থাপত্য’ দুটি বিষয়ই নির্ভর করে একটি এলাকার ভৌগোলিক কাঠামো, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নৃ-তত্ত্ব ইত্যাদির ওপর। দেশ ও সমাজভেদে স্থাপত্যের মতোই সবুজ স্থাপত্যের ধরনও হয় ভিন্ন। সে কারণেই সবার প্রথমে খনার বচনটি বললাম। 

সবুজ স্থাপত্য সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা প্রায়ই দেখা যায় যে, ভবনে গাছ লাগিয়ে দিলেই তা সবুজ স্থাপত্য। মূলত তা নয়। একটি ভবন কতটা টেকসই ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার ওপর নির্ভর করে তা কতটা সবুজ স্থাপত্যের শর্তগুলো পূরণ করে। যেমন একটি ভবনের বিদ্যুৎ খরচ কম রাখা, ভবনের আপৎকালীন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা, পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা, ভবনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা, আসবাবপত্র তৈরির ক্ষেত্রে কাঠের ব্যবহার হ্রাস করা, স্থাপত্য নির্মাণের মাধ্যমে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে না দেওয়া ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যই নির্দেশ করে একটি স্থাপত্য কতটা ‘সবুজ’ বা ‘টেকসই’ হবে। 

বাংলাদেশে ‘সবুজ স্থাপত্য’ চর্চার শুরু খুব সাম্প্রতিকই বলা চলে। বছর দশেক হলো এদেশের মানুষ স্থাপত্যের এ নতুন ধারা সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। আজকাল স্থপতিদের পাশাপাশি সবাই সবুজ স্থাপত্যের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠছে। ‘লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন সার্টিফিকেট বা লিড সার্টিফিকেটের মাধ্যমে গ্রিন বিল্ডিং বা সবুজ স্থাপনার সনদ প্রদান করা হচ্ছে। আবাসিক ভবন, প্রাতিষ্ঠানিক ভবন, অফিস বা কারখানা ইত্যাদি অনেক স্থাপনার ক্ষেত্রেই সবুজ স্থাপত্যের নিয়মনীতি মেনে চলা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৭৮টি গ্রিন ফ্যাক্টরি বিল্ডিং আছে, যেগুলো লিড সনদপ্রাপ্ত। এসব ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব দূষিত জল শোধনাগার আছে, যাতে করে প্রাকৃতিক জলাধারগুলোতে কারখানার দূষিত পানি না মেশে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে বাংলাদেশ অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে। এক্ষেত্রে স্থাপনা ও নগর পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় নীতিমালা এমনভাবে গ্রহণ করা উচিত যেন এর ব্যাপ্তি ও বিস্তার বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি দূষণমুক্ত নগর, দেশ সর্বোপরি পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। 

প্রকৃতিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। সে প্রকৃতিকেই আমরা রক্ষা করতে পারছি না শুধু সঠিক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা, নীতিমালা ও সদিচ্ছার অভাবে। ‘সবুজ স্থাপত্য’ চর্চার প্রসার বৃদ্ধির মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে পারি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-এর ১১ নম্বর লক্ষ্য হলো মানুষের জন্য নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, দুর্যোগসহনীয় শহর ও আবাসনের ব্যবস্থা করা। আর এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সবুজ স্থাপত্য ও সবুজ নগর পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। 

এ ছাড়া আগামী পৃথিবী হবে চরম ভাবাপন্ন জলবায়ুর পৃথিবী। সে পৃথিবীতে বেড়ে যাবে রোগবালাই ও মহামারি, যার ফল ভোগ করবে আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানরা। কেউই বাদ যাবে না, কারোরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা যাবে না। তবে এ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমন করার উপায় আছে যা নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের মধ্যে নিহিত। আমাদের নগরগুলোকে গড়ে তুলতে হবে টেকসই করে, যেখানে ভবনগুলোতে প্রয়োজন হবে না যান্ত্রিক তাপ নিয়ন্ত্রকের, মানুষের যানবাহনের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে অনেকাংশে যার ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ। থাকতে হবে উপযুক্ত নীতিনির্ধারণ, আইন ও বিধিমালা, যার ফলে নিষিদ্ধ হবে নগরায়ণের নামে অবাধে বৃক্ষনিধন, জলাশয় ভরাট ও কৃষিজমির বিনাশ। প্রয়োজনে আইন করে ভবনে ঢালাও কাচের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক আলো বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

সবুজ স্থাপত্য চর্চা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে। জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সৌর ও জলবিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতাকে অনুধাবন করতে হবে সব পেশার মানুষকে, নীতিনির্ধারকদের তো বটেই। বদলে যাওয়া পৃথিবীতে পরিবেশের যে বদল তা একদিকে মনুষ্যসৃষ্ট, আরেকদিকে কালের পরিক্রমায় পৃথিবীর নিজস্ব রঙ বদলানো। এ দুয়ের সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করতে হবে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের। 

সবুজ নগরে সবুজ স্থাপত্য-পরিবেশকে বাঁচাতে এটাই হোক পেশাজীবীদের স্লোগান।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close