কুরবানির ঈদ আসন্ন। এ ঈদকে সামনে রেখে যেমন গরু পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মেহেরপুরের পারিবারিক ও বাণিজ্যিক খামারিরা। কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে গরু পালনের দিকে ঝুঁকেছেন তারা। এদিকে গরুর বায়না দিতে খামার ও বাড়ি বাড়ি ছুটছেন বেপারিরা। লাভের আশায় আগাম বায়না দিচ্ছেন পছন্দের গরুটি কেনার জন্য। তবে পারিবারিক খামারিদের দাবি বেপারিরা ভালো দাম দিতে চাচ্ছে না। এদিকে প্রতিবেশী দেশ থেকে গরু আমদানির আশঙ্কায় চিন্তিত খামারিরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশু পালনে বাড়তি মনোযোগী হয়েছেন খামারি ও গেরস্থরা। শেষ সময়ে পশুকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখছেন, করছেন বাড়তি যত্ন। গোসল করানো, কাঁচা ঘাস সংগ্রহ ও পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করা যেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও হাটে নেওয়ার আগে গরুর শারীরিক পরীক্ষা ও চিকিৎসাও সেরে নিয়েছেন তারা। খামারিরা জানান, গোখাদ্যের পাশাপাশি চিকিৎসা খরচ, ওষুধ ও পালন ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। হাটে গরু তোলার জন্য পরিচিত সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন বেপারিরা। সুযোগ বুঝে দরদাম ঠিক হলে বায়না করে রাখছেন। বেপারিরা ঈদের কিছুদিন আগে ঢাকার বাজার ধরতে কুরবানির হাটে তুলবেন পশুগুলো। তাই এই শেষ সময়ের তোড়জোড়। সারা বছর বাড়তি দামে খাবার ও চিকিৎসা খরচ সামলে খামারিরা আশা করছেন, যদি পাশর্^বর্তী দেশ থেকে পশু আমদানি না করা হয় তা হলে তারা ন্যায্যমূল্য পাবেন।
গাংনীর আহম্মদ আলী এগ্রোর স্বত্বাধিকারী জানান, তার খামারে রয়েছে ১০০টি গরু। এর মধ্যে ৮০টি গরু তিনি ঢাকার হাটে তুলবেন। শেষ সময়ে গরুর গোসল দেওয়া, কাঁচা ঘাস সংগ্রহ ও পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করা যেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ব্রাহামা, হরিয়ান, নেপালি ও ফ্রিজিয়াম জাতের গরুর পাশাপাশি দেশি গরুও পালন করছেন তিনি।
দুবছর ধরে সাতটি এঁড়ে গরু পালছেন শিমুলতলা গ্রামের মাসুম। তিনি বলেন, নেপালি জাতের প্রতিটি গরু ৭৫ হাজার টাকা করে কিনেছি। দুবছর অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে এগুলোর পেছনে। এখন বাড়িতে এসে বেপারিরা প্রতিটি গরুর দাম বলছেন দুই লাখ টাকা। এতে তেমন লাভ হচ্ছে না। তবে আরও একটু দাম বেশি হলে বিক্রি করবেন বলে জানান তিনি। তা না হলে ঢাকার হাটে নিয়ে যাবে গরুগুলোকে।
কুলবাড়িয়া গ্রামের ময়নাল হক জানান, তাদের চার ভাইয়ের ২১টি গরু আছে। গেল কুরবানির ঈদে গরু বিক্রি করে নীলফামারী থেকে বাছুর গরু কিনে এনে লালন পালন করছেন তারা। একেকটি বাছুর ৩৫ হাজার টাকা করে কিনে পালছেন। এখন বেপারিরা একেকটি গরুর দাম বলছে লাখ টাকার বেশি। রাত দিন সমানে বেপারিরা আসছেন। বেপারিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরুর অগ্রিম দাম দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে ঈদের আগ পর্যন্ত গরুর খাবারের দামও দিচ্ছেন তারা।
রায়পুর গ্রামের চায়না খাতুন জানান, তিনি গত কুরবানির পর ৬০ হাজার টাকায় একটি বাছুর গরু কেনেন। লালন পালনে খরচ গেছে ৩০ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারে তার গরুটির দাম উঠেছে দেড় লাখ টাকা টাকা। সরকারিভাবে তাদের মতো গরু পালনকারীদের জন্য প্রণোদনা দাবি জানান তিনি। একই কথা জানিয়েছেন সহগলপুরের গৃহবধূ হাবিবা। তিনি এবার সমিতি থেকে লোন নিয়ে তিনটি গরু পালছেন। এবার দেড় লাখ টাকার মতো লাভ হবে বলে আশা করছেন তিনি।
গরু ব্যবসায়ী রুয়েরকান্দি গ্রামের আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি ও তার ভাই প্রতি কুরবানির ঈদে ঢাকার কমলাপুরে গরু নিয়ে যান। গত বছর ১০ ট্রাক গরু নিয়েছিলেন ঢাকায়। বিভিন্ন হাট থেকে গরু কিনলে নিজ বাড়িতে পরিচর্যা ও খাবারের ব্যবস্থা করা বেশ ঝামেলা। তাই গেরস্থ বাড়ি থেকে গরু কিনে ওই বাড়িতেই বাড়তি খরচ দিয়ে রেখে দেন। কুরবানির ঈদের আগে ট্রাক লোড দেয়ার সময় নিয়ে যান তারা। গত ১৫ দিনে ৭৪টি গরু কিনেছেন তারা।
গরুর বেপারি শিপাত আলী জানান, প্রতি ঈদের সময় বেশ কয়েক ট্রাক গরু ঢাকায় বিক্রি করেছেন। এবারও তিনি গরু ঢাকাতে নিয়ে যাবেন। এ জন্যই ঈদের আগেই অনেক সময় গরু পালনকারীদের কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে গরু নিয়ে যাওয়া হয়। কেনাবেচা শেষে টাকা পরিশোধ করে দেয়।
মেহেরপুর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হারিছুল ইসলাম জানান, জেলায় চলতি বছর বাণিজ্যিকভাবে পাঁচ হাজার এবং ২২ হাজার পারিবারিক খামারিদের গরু-ছাগল রয়েছে। এবার কুরবানির জন্য পশুর চাহিদা রয়েছে ৯০ হাজার পশু। কিন্তু কুরবানির জন্য প্রায় ২ লাখ পশু প্রস্তুত রয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের মাধ্যমে অনলাইনেও গরু এবং ছাগল বিক্রয় করা যায়। প্রতি বছরের মতোই জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হবে। চলছে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা। সজাগ রাখা হয়েছে প্রাণিসম্পদ বিভাগের লোকজন ও স্বেচ্ছাসেবীদের।