ঘূর্ণিঝড় রিমালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন-বিতরণ ব্যবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। এখনও ১ কোটিরও বেশি (মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত) গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় ঢাকাসহ সারা দেশে মঙ্গলবার দফায় দফায় লোডশেডিং হয় এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বিতরণ লাইনে সমস্যার কারণে ওই এলাকাগুলো অন্ধকারে রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
গত সোমবার রাত ১টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ন ৩ হাজার মেগাওয়াটের ঘরে নেমে যায়। মঙ্গলবার ভোর ৫টায় সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৬৫১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এ সময় সারা দেশে একই পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন বাড়তে থাকে। মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় চাহিদা সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। এ সময় উৎপাদন ছিল ১০ হাজার ৬২১ মেগাওয়াট। কোনো ঘাটতি ছিল না। পিডিবি ও পিজিসিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে অধিকাংশ জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। এ জন্য উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে কিন্তু উৎপাদন না বাড়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা দিয়েছে, সেগুলো মেইনটেন্যান্স করতে গিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
দেশের অনেক এলাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ায় মোবাইল ফোনে চার্জ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম মঙ্গলবার বিকালে জানান, আধা ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ঝড়ো বাতাসে বাগেরহাটে পল্লীবিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে দুদিন পরেও গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো যায়নি। প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহক অন্ধকারে রয়েছেন।
পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির বাগেরহাট কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) সুশান্ত রায় মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যুৎ লাইনের ওপর গাছপালা উপড়ে এবং সঞ্চালন লাইন ছিঁড়ে পল্লীবিদ্যুতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেড় হাজারেরও বেশি গাছপালা উপড়ে ৭০২টি পয়েন্টে তার ছিঁড়ে পড়েছে। ১৩০টি বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে ও ভেঙে গেছে, ৩৫টি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে, ৩৯৪টি মিটার ভেঙে গেছে।
জেলার নয় উপজেলাসহ খুলনার কিছু অংশ নিয়ে পল্লীবিদ্যুতের এই বিভাগের অধীনে চার লাখ ৮৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। তারা পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ পাবেন তবে সেটি কখন তা বলতে পারছে না পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা আসলাম উদ্দীন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সময়ের আলোকে জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় ৮০টি পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির ভৌগোলিক এলাকায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ ও এর ক্ষয়ক্ষতির প্রতিকারে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৮০টি পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির বিচ্ছিন্ন হওয়া ৮০ শতাংশ গ্রাহকের মধ্যে বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ সম্পন্ন হয়েছে।
অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ৮০টি পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ৩ কোটি ৩ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে ২ কোটি ৪২ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ প্রদান করা সম্ভব হয়। রাত ১০টার মধ্যে ৮৫ শতাংশ পুনঃসংযোগের কাজ শেষ হবে। এখনও ৬৫ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছেন। তাদের বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজ পর্যায়ক্রমে চলতে থাকবে। আজ বুধবার সকালের মধ্যে ৯০ শতাংশ গ্রাহকের বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়।
এর আগে বিকাল সাড়ে ৫টায় বলা হয়, মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে এক কোটি ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৭০২ জনকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এখনও এক কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছেন। সে হিসাবে ৫ ঘণ্টায় ১ কোটি ৬ লাখেরও বেশি গ্রাহককে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাথমিক তথ্যানুসারে ১০৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সমিতি, আরইবি’র ঠিকাদার ও জনবলসহ ৩০ হাজারেরও অধিক জনবল মাঠে কাজ করছে। মঙ্গলবার রাতের মধ্যে ৬০ শতাংশ গ্রাহক এবং বুধবারের মধ্যে সব ৩৩ কেভি ও ১১ কেভি লাইন চালুর মাধ্যমে ৮০ শতাংশ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। বাকি গ্রাহকদের সার্ভিস ড্রপ ও মিটার ঠিক করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে হবে, তাই পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি জানান, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) মোট গ্রাহকসংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৪, বর্তমান বিদ্যুতায়িত গ্রাহক সংখ্যা ১৪ লাখ ৩ হাজার ৫২৬, এখনও রিকভারি বাকি এক লাখ ৪৪ হাজার ৬২৮ জন গ্রাহক। প্রাথমিক তথ্যানুসারে ওজোপাডিকোর ক্ষয়ক্ষতি ৫ কোটি ৭ লাখ ৮১ হাজার ৭০২ টাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ দ্রুত স্বাভাবিক করার জন্য কাজ চলমান রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগির সব লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
সময়ের আলো/জিকে