ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

‘শ্রম, ইচ্ছাশক্তি আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে এতদূর এসেছি’
প্রকাশ: বুধবার, ২২ মে, ২০২৪, ২:১৭ এএম  (ভিজিট : ৩১৪)
শাপলা বেগম। জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার নদীভাঙন কবলিত এলাকায় তার জন্ম। সাপধরী ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামের শাহ্ মো. বেলায়েত হোসেনের মেয়ে। বাবার ছিল সারের ব্যবসা। সচ্ছল পরিবারে ছিল নিজেদের ঘরবাড়ি আর বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। 

কিন্তু বাদ সাধে ১৯৯৭ সালে যমুনা নদীর ভয়াবহ ভাঙন। সেই ভাঙনের কবলে বাড়িঘর-জমিজমা সব তলিয়ে গেল নদীগর্ভে। সচ্ছল বেলায়েত হোসেন একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়লেন। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেল ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে শাপলা বেগমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জামালপুর শহরে তার মামার বাড়িতে। বাবার দুরবস্থা দেখে ২০০১ সালে মা সালমা বেগমও জামালপুরে তার ভাইয়ের বাড়িতে চলে আসেন। নদীগর্ভে সর্বস্ব হারিয়ে পারিপার্শ্বিক চাপে অসুস্থ এবং পরে শয্যাগত হয়ে পড়েন বেলায়েত হোসেন। শাপলা তখন জামালপুর সিংহজানী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। 

মামাবাড়িতে এসে মা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। সেলাইয়ের কাজ করে মা ভালোই উপার্জন শুরু করলেন। বাবার অসুস্থতা বেড়ে গেলে মা শাপলাকে নিয়ে ইসলামপুরে ফিরে আসেন। 

স্থানীয় চিনাডুলী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন শাপলা। একই সঙ্গে অভাবের সংসারে মাকে সেলাইয়ের কাজে সাহায্য করা শুরু করেন। বাবার অবশিষ্ট জমিতে কৃষিকাজ চললেও তাতে বছরের বাকি সময় চলে না। মায়ের আয়েই সংসারের সব খরচ চলতে থাকে। এভাবেই যায় কিছুদিন। এর পরেই জীবনে আসে ভিন্ন এক মোড়। 

বাল্যবিয়ের শিকার 
২০০৩ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে শাপলা বেগমের বিয়ে হয়ে যায়। বরের নাম আরজু শেখ। জামালপুর পৌর শহরের বগাবাইদ এলাকার মৃত মো. শেখ ফরিদের ছেলে। বিয়ের সময় আরজু ছিল বেকার। বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই শাপলা চলে আসেন জামালপুরে তার শ^শুরবাড়িতে। বাল্যবিয়ের অবধারিত নিয়মানুযায়ী বিয়ের পরে বন্ধ হয়ে যায় তার পড়াশোনাও। 

বেকারত্ব দূর করার জন্য আরজু শেখ ২০১১ সালে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সেই টাকা থেকে শাপলা মাত্র ৩ হাজার টাকা নিয়ে ৫টি থ্রি পিস ও ৬টি ওয়ান পিস তৈরি করেন। এরপর তার তৈরি পোশাকগুলো বগাবাইদ নিজ এলাকাতেই বিক্রি করে লাভ হয় ১২শ টাকা। অভাবের সংসার যেন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ওই সময় শাপলা বগাবাইদ এলাকায় একটি হস্তশিল্পের শোরুমও খুলে বসেন। 

অপরদিকে বর আরজু শেখ ঋণের বাকি টাকা দিয়ে শহরের শহিদ হারুন সড়ক মার্কেটে মোবাইল পার্টসের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে শাপলার হস্তশিল্পের ব্যবসার বেশ প্রসার ঘটেছে। তিনি পৌর শহরের কলেজ রোড শহিদ হিরু সড়ক এলাকায় বড় ছেলের নামানুসারে সাম্য হস্তশিল্প নামে একটি শোরুম খুলে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। শাপলার শোরুমে গিয়ে দেখা যায় শোকেসে থরে থরে সাজানো বাহারি রঙের নয়নাভিরাম নানা রকমের পোশাক। তার শোরুমে রয়েছে বিভিন্ন রঙের ওয়ানপিস, থ্রিপিস, কটি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, নকশিকাঁথা, নকশি চাদর, কুশন কভার ও পাটজাত বিভিন্ন পণ্য।

ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংসারের চাপে নুয়ে পড়ছিলেন শাপলা। লেখাপড়া করার যে সুপ্ত ইচ্ছে মনের মাঝে ছিল, সেটি যেন ক্রমশ অনুজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। বিয়ের বহু বছর বাদে বরের কাছে খুলে বললেন মনের কথা। দাম্পত্য জীবনের বয়স তখন অনেকদিন। বর ততদিনে বুঝতে শিখেছেন স্ত্রী শাপলা তার জীবনের উজ্জ্বল ফুল। সবমিলিয়ে এ দফায় শাপলার ভাগ্যরেখা ছিল উজ্জ্বল। বরের উৎসাহে ২০১৭ সালে মেলান্দহ উপজেলার কেপি আঞ্জুমান আরা ফারুক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০২০ সালে ইসলামপুর ফারাজীপাড়া বিএম স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।

দুই সন্তানের জননী শাপলা নিজের এবং বরের ব্যবসার আয় থেকে এখন বেশ সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। বড় ছেলে মো. শেখ শাফি সাম্য শেরপুর কৃষি ইনস্টিটিউটে কৃষি ডিপ্লোমা কোর্সে আর ছোট মেয়ে সিজদা শেরপুর জেলা গার্লস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। মাত্র ৩ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করা শাপলার দোকানে এখন প্রায় ১২ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে। শাপলার হস্তশিল্পের সঙ্গে বর্তমানে ২শ সেলাই কর্মী ও ৬ জন গ্রুপ লিডার জড়িত। জেলার শ্যাগমঞ্জ কালীবাড়ি, নারিকেলী, নরুন্দি, তুলশীপুর, মেলান্দহ প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে আছে শাপলার নারীকর্মীরা। তারা ট্রেসিং পেপার দিয়ে ছাপ দেওয়া কাপড়ে বাহারি রঙের সুতায় ফুটিয়ে তোলেন দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শাপলার শোরুমে চলে পণ্য বিক্রি। ঈদ-পূজা-পার্বণ ছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে শাপলার দোকানে বিক্রি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তখন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খোলা রাখতে হয় শোরুম। 

আবার ঘুরে দাঁড়ানো 
শাপলার ব্যবসা যখন তুঙ্গে, ঠিক সে সময় ২০২০ সালে তার শোরুমে এক ভয়াবহ চুরির ঘটনা ঘটে। সে সময় অনেকটাই ভেঙে পড়েন শাপলা। তখন বর আরজু শেখের উৎসাহ আর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আবার ঘুরে দাঁড়ান শাপলা বেগম। বর্তমানে শাপলার তৈরি পোশাক সাভার, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, যশোর, ধনবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। ব্যবসার প্রসারের জন্য শাপলা বেগম অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৫ লাখ এবং কৃষি ব্যাংক থেকে আরও ৪ লাখ টাকা ঋণ নেন। শাপলা বেগম যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে ২০০৮ সালে পোশাক তৈরির ওপর আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
 
জামালপুর যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশিক্ষক মোছা. শামীমা বেগম বলেন, শাপলা বেগমের কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে আমি বেশ মুগ্ধ। পরে আমি তাকে আরও উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে ভালোভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য উৎসাহ দিই। তিনি বলেন, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হস্তশিল্পের ব্যবসা করে শাপলা বেগম আজ স্বাবলম্বী।

আত্মপ্রত্যয়ী শাপলা বেগম বলেন, অভাব আর দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে নিজের শ্রম, ইচ্ছাশক্তি আর মেধা কাজে লাগিয়ে আজ আমি এতদূর এসেছি।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close