ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ইলম অর্জনের তিন শর্ত
প্রকাশ: শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪, ৩:১২ এএম  (ভিজিট : ৯৮০)
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য চমৎকার কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সুরা কাহাফের মধ্যেই রয়েছে এমন চারটি ঘটনা। আমরা সেখান থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করব। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেননি, বরং মূল পয়েন্টগুলো বলে দিয়েছেন। আর হাদিসে নবীজি (সা.) উম্মতের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, একদিন হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরাইলের এক সভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্য চলাকালীন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী কে? মুসা (আ.)-এর জানামতে ওই সময়ে তারচেয়ে অধিক জ্ঞানী আর কেউ ছিলেন না। তিনি বললেন, আমিই সবচেয়ে জ্ঞানী। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নৈকট্যশীল বান্দাদের বিশেষভাবে গড়ে তোলেন। 

তাই তাঁর এ জবাব আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করলেন না। এখানে বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ছিল আদব। অর্থাৎ একথা বলা উচিত ছিল যে, এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। মুসা (আ.)-এর জবাবের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে তিরস্কার করে ওহি নাজিল হলো, ‘দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী।’ এ কথা শুনে মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন সেই জ্ঞানী মানুষের সাহচর্য লাভের জন্য। বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে আপনি তাঁর ঠিকানা বলে দিন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিন এবং দুই সমুদ্রের মিলনস্থলের দিকে সফর করুন। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেখানেই আমার এই বান্দার সাক্ষাৎ পাবেন। মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর খাদেম ইউশা বিন নুন। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে একটি প্রস্তর খণ্ডের ওপর মাথা রেখে তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। এখানে হঠাৎ মাছটি নড়াচড়া করতে লাগল এবং থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে চলে গেল। মাছটি সমুদ্রের যে পথ দিয়ে চলে গেল, আল্লাহ তায়ালা সে পথে পানির স্রোত বন্ধ করে দিলেন। ফলে সেখানে পানির মধ্যে একটি সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গেল। ইউশা বিন নুন এই আশ্চর্যজনক ঘটনা নিরীক্ষণ করছিলেন।

মুসা (আ.) ঘুমিয়ে ছিলেন। যখন জাগ্রত হলেন, তখন ইউশা বিন নুন মাছের এই আশ্চর্যজনক ঘটনা তাঁর কাছে বলতে ভুলে গেলেন। এরপর সেখান থেকে সামনে রওনা হয়ে গেলেন। পূর্ণ একদিন-একরাত সফর করার পর সকাল বেলায় মুসা (আ.) তাকে বললেন, আমাদের খাবার নিয়ে আসো। আমরা সফরে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। খাবার চাওয়ার পরই ইউশা বিন নুনের মাছের ঘটনা মনে পড়ে গেল। তিনি ভুলে যাওয়ার ওজর পেশ করে বললেন, শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। তারপর বললেন, মৃত মাছটি জীবিত হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে চলে গেছে। তখন মুসা (আ.) বললেন, সে স্থানটিই তো আমাদের লক্ষ্য ছিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে চললেন। প্রস্তর খণ্ডের নিকট পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে আছেন। মুসা (আ.) সালাম করলে খিজির (আ.) বললেন, এই নির্জন জায়গায় সালাম কোথা থেকে এলো? মুসা (আ.) বললেন, আমি মুসা। খিজির (আ.) জানতে চাইলেন, বনি ইসরাইলের মুসা?

তিনি বললেন হ্যাঁ, আমিই বনি ইসরাইলের মুসা। আমি আপনার থেকে ওই বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। খিজির (আ.) বললেন, যদি আপনি আমার সঙ্গে থাকতে চান, তবে কোনো বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে তার অবস্থা সম্পর্কে বলে না দেব।
এ কথা বলার পর উভয়ে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একটি নৌকা এলে তারা নৌকায় আরোহণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। মাঝিরা খিজিরকে চিনে ফেলল এবং কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদের নৌকায় তুলে নিল। নৌকায় চড়েই খিজির কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন। এতে মুসা (আ.) চুপ থাকতে না পেরে বললেন, তারা কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদের নৌকায় তুলে নিয়েছে। আপনি কি এরই প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙে দিলেন যাতে সবাই ডুবে যায়? আপনি অতি মন্দ কাজ করেছেন।

খিজির বললেন, আমি আগেই বলেছিলাম আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। তখন মুসা (আ.) ওজর পেশ করে বললেন, আমি ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি রাগ হবেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, মুসা (আ.)-এর প্রথম আপত্তি ভুলক্রমে, দ্বিতীয় আপত্তি শর্ত হিসেবে এবং তৃতীয় আপত্তি ইচ্ছাক্রমে হয়েছিল। তখন একটি পাখি উড়ে এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। খিজির (আ.) মুসা (আ.)-কে বললেন, আমার জ্ঞান এবং আপনার জ্ঞান উভয়ের মিলে আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের মোকাবিলায় এমন তুলনাও হয় না, যেমনটি এ পাখির চঞ্চুর পানির সঙ্গে রয়েছে সমুদ্রের পানি।

তারপর তাঁরা নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। হঠাৎ খিজির একটি বালককে অন্যান্য বালকের সঙ্গে খেলা করতে দেখলেন। খিজির বালকটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। বালকটি মারা গেল। মুসা (আ.) বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ প্রাণকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন। এটা অনেক বড় গুনাহের কাজ। খিজির বললেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। মুসা (আ.) দেখলেন, এ ব্যাপারটি আগের চেয়েও গুরুতর। তাই বললেন, এরপর যদি কোনো প্রশ্ন করি তা হলে আপনি আমাকে পৃথক করে দেবেন। এরপর তারা আবার চলতে লাগলেন। এক গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। গ্রামবাসী সোজা অস্বীকার করে দিল। খিজির এই গ্রামে একটি প্রাচীরকে পতনোন্মুখ দেখতে পেলেন। তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন। মুসা (আ.) বিস্মিত হয়ে বললেন, আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করল। অথচ আপনি তাদের এত বড় কাজ করে দিলেন, ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খিজির বললেন, এখন শর্ত শেষ হয়ে গেছে। এটাই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়।

এরপর খিজির (আ.) উপরোক্ত ঘটনাগুলোর স্বরূপ মুসা (আ.)-এর নিকট বর্ণনা করে বললেন, এ হচ্ছে সেসব ঘটনার স্বরূপ, যেগুলো আপনি দেখে ধৈর্য ধরতে পারেননি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, মুসা (আ.) যদি আরও কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরও কিছু জানা যেত (বুখারি : ১২২)। এই ঘটনায় আমরা খিজির (আ.)-এর তিনটি কাজ দেখতে পারি। এই কাজগুলোর ব্যাখ্যা এই হাদিসে রাসুল (সা.) করেননি। 

কিন্তু অন্য হাদিসে এগুলোর ব্যাখ্যা রয়েছে। আমাদের যেহেতু ব্যাখ্যা উদ্দেশ্য নয়, সুতরাং আমরা সেটা এখানে বলতে চাচ্ছি না। আমরা ঘটনার শিক্ষাটা উপস্থাপন করতে চাচ্ছি। এই কুরআনিক ঘটনায় আমরা জ্ঞান অর্জনের তিনটা শর্ত খুঁজে পাই। আমরা এখান থেকে জানতে পারি, জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনটা শর্ত রয়েছে।

প্রথমত সফর, জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানী মানুষের নিকট সফর করতে হবে। দ্বিতীয়ত সবুর, ধৈর্য ধরতে হবে। তাড়াহুড়া করা যাবে না। তাড়াহুড়া জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তৃতীয়ত বিনয়, জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানী মানুষের নিকট বিনয়ী হয়ে থাকতে হবে। নম্র হতে হবে। আমাদের সবার জীবনেই জ্ঞানের প্রয়োজন। জ্ঞান ছাড়া দুনিয়ায় চলা অসম্ভব। আমরা সবাই জ্ঞান অর্জন করতে চাই। আমরা যদি আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে শর্তগুলো মেনে চলি, তা হলে আমাদের জন্য জ্ঞান অর্জন করা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। সবুর, সফর ও বিনয়ের মাধ্যমে আমরা যেন জ্ঞান অর্জন করতে পারি, আল্লাহ তায়ালা সেই তওফিক দান করুন।

আলেম ও প্রাবন্ধিক

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close