ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
প্রকাশ: শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪, ২:৪২ এএম  (ভিজিট : ১১৬০)
বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। যার সজীব ও প্রাণবান অবস্থান শুধু ইন্দ্রিয়গোচর হয়ে থাকেনি, তার মৃত্যুর এত বছর পরও বিংশ শতাব্দী পার হয়ে-এই একবিংশ শতাব্দীতেও তিনি দিন দিন হয়ে উঠেছেন আরও দেদীপ্যমান এবং নিকটবর্তী ও প্রয়োজনীয়। রবীন্দ্রনাথ আছেন বলেই বাংলা সাহিত্য কী গভীরতা ও বিস্তৃতি নিয়ে হয়েছে গুরুত্ববাহী ও বিকাশশীল! তিনি তার স্বকীয় সৃজনশীল শক্তির এতটা পরিচয় দিয়েছেন বলেই এখনও তিনি আলোচিত হচ্ছেন বিভিন্ন পরিধিতে, এখনও তাকে নিয়ে মূল্যায়ন, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ শেষ হচ্ছে না! 

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত গভীর পর্যবেক্ষণে যথার্থ বলেছেন-‘রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সক্রিয় তথা সর্বতোমুখ সাহিত্যিক বাংলাদেশে ইতিপূর্বে জন্মাননি এবং পরবর্তীরা আত্মশ্লাঘায় যতই প্রাগ্রসর হোন না কেন, অনুভূতির রাজ্যে সুদ্ধ তারা এমন কোনো পথের সন্ধান পাননি যাতে রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্ন নেই। বস্তুত তার দিগ্বিজয় জয়ের পরে বাংলা সাহিত্যের যে অবস্থান্তর ঘটেছে তা তার অসীম সাম্রাজ্যের অনেক জমি জোতদারের দখলে এসেছে; এবং তাদের মধ্যে যারা পরিশ্রমী, তারা নিজের নিজের এলাকায় শস্যের পরিমাণ বাড়িয়েছে মাত্র। 

ফসলের জাত বদলাতে পারেনি।’ রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন সমানতালে সক্রিয় থেকেছেন। এতটা আত্মপ্রত্যয়ী ও অনুধ্যান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সৃজনশীল কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে কি তিনি বেদনাক্লিষ্ট হননি? হয়েছেন! হাঁপিয়ে পড়েননি? পড়েছেন! রবীন্দ্রনাথের জীবন তো একরৈখিক ছিল না, বহুরৈখিক জীবনের স্বাদ নিয়ে ছিল দ্বন্দ্ব ও জটিলতায় কষ্টকর, বহু ধরনের বিরূপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পতিত হয়েছেন, অশান্তির পর্বে পর্বে হয়েছেন রক্তাক্ত! আমরা অনেকে ভাবি-তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করার পর-সোনায় মোড়ানো পথে হেঁটেছেন, তা কিন্তু ঠিক নয়।

১৮৯৬ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সময়ের নিরিখে দেখি-একদিকে তিনি কর্মব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আর অন্যদিকে সংকট ও সমস্যা একটার পর একটা এসে টেনে ধরছে। এই সময়ে তিনি কখনো শিলাইদহ, কখনো কলকাতা, কখনোবা বোলপুর। কোথাও স্থিতি নেই! অস্থির হয়ে দিনযাপন। 

ব্যক্তিজীবনে আঘাত ও দুর্বিপাকের ভেতর কুষ্টিয়ায় পাটের ব্যবসায় প্রচুর ক্ষতি, সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আর্থিক ঋণ গ্রহণ। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে শিলাইদহে বসবাস। স্ত্রীর আপত্তির মুখে শিলাইদহে বসবাসের সংকল্প ত্যাগ। এরপর এক এক করে অল্প সময়ের ব্যবধানে এলো পিতার মৃত্যু, কন্যার মৃত্যু, স্ত্রীর মৃত্যু এবং আরও ক’জন নিকটজনের মৃত্যু! ব্রাহ্ম ও সনাতন ধর্ম নিয়ে বাগবিতণ্ডা ও বিরোধ। স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান ও মতভেদ, অতঃপর সংস্রব ত্যাগ। কন্যার বিবাহ। পুত্র ও জামাতাকে বিদেশে প্রেরণ। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুকে বিলাতে প্রেরণের অর্থ সংগ্রহ। 

জামাতার সঙ্গে অপমানসূচক সম্পর্কের মুখোমুখিও হলেন। এমন সব যন্ত্রণাতুর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও কী-এক দর্শনানুভূতি নিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ করে তার সাহিত্যসাধনাকে বিপর্যস্ত হতে দেননি।

এরপরও দেখি-নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দুবছর পর রবীন্দ্রনাথ তার চিঠিপত্রে লিখলেন-‘কিছুকাল থেকেই আমার একটা nervous breakdown হয়েছে তার সন্দেহ নেই। যে কোন কাজ করতুম অন্তত জোর করে করতে হত। 

আর মনের মধ্যে একটা গভীর বেদনা ও অশান্তি লেগেই ছিল। দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না, আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ; -অন্যদের সকলের সম্বন্ধেই নৈরাশ্য এবং অনাস্থা।’ 

সমাজের প্রতিকূলতা এমনই পর্যায়ে গিয়েছিল, অন্যদের ওপরও আস্থা রাখা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এমনকি বললেন-‘আমি Deliberately Suicide করতে বসেছিলাম।’ কী ভয়াবহ বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে জীবনের প্রতি এতটাই বিতৃষ্ণাকাতর হয়ে বিবমিষা তৈরি হয়েছিল, তা ভাবলে অবাক লাগে। 

শেষ পর্যন্ত আত্মশক্তি উদ্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথে ধ্যানমগ্ন হন, তা তার ভাষ্য থেকে আমরা জানি-‘আমি কিছুদিন সুরুলের ছাদে শান্ত হয়ে বসে আবার আমার চিরন্তন স্বভাবকে ফিরে পাব সন্দেহ নেই-মৃত্যুর যে গুহার দিকে নেবে যাচ্ছিলুম তার থেকে আবার আলোকে উঠে আসব কোনো সন্দেহ নেই।’ এমন অবস্থা বেশিদিন চলেনি, নিজের আত্মশক্তির ভেতর থাকা মানসিক ঐশ্বর্যকে অদূরবর্তী না রেখে আত্মপরীক্ষায় নিজে নিজেই উত্তীর্ণ হয়েছেন, তা না হলে তার সৃষ্টিশীলতা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সংকুচিত হতো। 

তার জীবনীশক্তি এত প্রবল ও গভীর ছিল বলেই-সারা জীবন সকল বয়সে তিনি বিস্ময়কর অভিনবত্ব নিয়ে ছিলেন সক্রিয় ও সৃজনশীল! এ-এক তুলনারহিত মানব উদাহরণ। তার বয়স যতই বেড়েছে, তার  কর্মকাণ্ডের গতি  কমেনি, বেড়েছে;  নতুন ও  নিরীক্ষামূলক কাজে মনোযোগী হয়েছেন। শেষ বয়সে ছবি এঁকেছেন, সেগুলো তাঁর অমর সৃষ্টি হয়েছে। 

৫২টি তার কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৮টি নাটক, ৩৬টি প্রবন্ধের বই, প্রায় দুই হাজারের মতো গান ও চিঠিপত্রসহ আরও অন্যান্য লেখা। অন্যদিকে ‘বিশ্বভারতী’ গড়ে তুলেছেন, সময়ের বিভিন্ন অভিঘাতে দেশের জন্য বিভিন্ন ধরনের সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেছেন। 

রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী-রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আগ্রহ দেশ ও দেশের বাইরে এখনও বাড়ছে, আমাদের সংস্কৃতির মূল উৎসবগুলোতে তার কী উজ্জ্বল উপস্থিতি, আমাদের অধিকার আদায় ও সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ এখনও থাকেন, আমাদের মননশীলতা বিকাশে ও অগ্রবর্তী বিষয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রেও তার চিন্তন আমাদের পাথেয় হয়ে ওঠে।  

আমাদের পার্থিবতায় তার অস্তিত্ব কম পরিব্যাপ্ত নয়। তার সাহিত্য ও গান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বহুজন পেশাগতভাবে সম্পৃক্ত, অর্থনৈতিকভাবেও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক কত শিক্ষক ও ছাত্র! তার রচনাবলি এবং তার সম্পর্কিত বইয়ের কাটতি এখনও বেশ। তার ভিত্তিমূল এইভাবে শক্ত ও দিগন্তপ্রসারী হয়ে উঠেছে। গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের মতো দ্বিতীয় আর কোনো বাঙালি প্রতিভা এতটা নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠার বৈজয়ন্তী নিয়ে উজ্জ্বল হতে পারেননি।

বিনীতভাবে বলি-আমাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে রবীন্দ্রনাথ কতভাবে যে সঙ্গী হয়েছেন, সেসব না বলেই একটা দিক শুধু বলি-রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার আবৃত্তি এখন স্মার্টফোনের বদৌলতে প্রতি রাতে শুনে ঘুমাই, না হলে অপূর্ণতা থেকে যায়, ঘুম আসে না! রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের অভিজ্ঞতা ও চৈতন্যের বহু স্তরের সংবেদনায় লিখেছেন বহু গান, সেই গানগুলো তার হৃদয়তন্ত্রীতে শুধু বাজেনি, আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতেও বাজছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হৃদয়েও বাজবে। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি প্রাণ’, ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’ ইত্যদি গান যখন শিল্পীর কণ্ঠ থেকে শ্রোতার হৃদয়ে প্রবেশ করে, তখন তা শুধু নিছক গান হয়ে থাকে না, ‘মনোচিকিৎসা’র ‘অটোসাজেন’ নামের পদ্ধতিও হয়ে ওঠে। এসব গান রবীন্দ্রনাথকেও মানসিক সংকট থেকে বাঁচিয়েছিল! আমাদেরও বাঁচায়!

শেষে বলি-রবীন্দ্রনাথ যখন আশি বছর বয়সে প্রবেশ করেন, তখন তিনি সেই লগ্নে এক রচনায় লিখেছিলেন-‘আমি সাধু নই, সাধক নই, বিশ্বরচনার অমৃত-স্বাদের আমি যাচনদার।’ সেই যাচনদারের জীবন ও কীর্তিকে কাছে টানলে আমাদের বোধভাষ্যি কখনো সংকুচিত হয় না, বরং আরও প্রসারিত হয়।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close