ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস
বাগানের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ চা শ্রমিকদের জীবন
প্রকাশ: সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১:২৭ এএম  (ভিজিট : ৮১৮)
ভোর হতেই লবণ দিয়ে এক মগ লাল চা আর সঙ্গে দুই মুঠো চাল ভাজা খেয়ে ছুটে যান চা বাগানে। অথচ নিজেদের উৎপাদিত চাও দুধ-চিনি মিলিয়ে খাওয়ার সামর্থ্য হয় না তাদের। কাঠফাঁটা রোদে দিনভর মাইলের পর মাইল হেঁটে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সংগ্রহ করেন চা পাতা। দুপুরের এক ফাঁকে মরিচ আর চা পাতার চাটনি মেখে খান ভাত, কখনো সঙ্গে থাকে মুড়ি কিংবা চানাচুর। এভাবেই কাটছে চা শ্রমিকের জীবনকাল। বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোঁক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে চা বাগানকে আঁকড়ে জীবন পার করছেন তারা। ঠিক যেমন চা গাছ ছেটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেওয়া হয় না তেমনিভাবে চা শ্রমিকের জীবনটাও যেন চা বাগানের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সবুজ কুঁড়ি বেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই আটকে আছে তাদের জীবনযাত্রা।

বংশ পরম্পরায় যে জমিতে চা শ্রমিকরা বসবাস করে সেই জমির ওপর কখনোই মেলে না অধিকার। তাই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকেই বাগানে কাজ করা বাধ্যতামূলক। দিনশেষে ২৩ কেজি পাতা তুললেই তবে পূরণ হয় মাথাপিছু লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেই তবে হাজিরা হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছ ছাঁটার সময় সারা দিনে অন্তত ২৫০টা চা গাছ ছাঁটতে হয়। কীটনাশক ছিঁটানোর বেলায় সারা দিনে অন্তত ১ একর জমিতে কীটনাশক ছিঁটানোর লক্ষ্যমাত্রার বোঝা কাঁধে নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। ফি বছর শ্রমিক দিবস এলে ঘটা করে পালন করা হয় দিনটি। কিন্তু চা বাগানের এসব শ্রমিকরা তাদের জীবনচক্র আটকে ফেলেছে চা বাগানের সঙ্গে।

চাকলা পুঞ্জি, চানপুর, দেউন্দি, লালচান, লস্করপুর, নালুয়া, রেমা, আমতইলসহ হবিগঞ্জ জেলায় মোট ২৪টি চা বাগান আছে। এসব চা বাগানে প্রায় ৪০ হাজার চা শ্রমিক কাজ করেন। তাদের সবার জীবন প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। তারা ১৭০ টাকা মজুরিতে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাজ করে। সন্ধ্যায় নাচ ঘরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করে রাতে খাবার শেষে আবার সকালে ফেরে সবুজ বাগানে। আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা তাদের সন্তানরাও ভোগে অপুষ্টিসহ বিভিন্ন অসুখে।

চা বাগানের নারী শ্রমিকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও তারা জানে না নারী অধিকারের কথা। জানে না শ্রমিকের অধিকার কী। অথচ এসব নারীরাই চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখলেও তারা বরাবরই অধিকারবঞ্চিত। দীর্ঘ আন্দোলনের পর তাদের ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করে দৈনিক ১৭০ টাকা করা হয়েছে। নারী চা শ্রমিকরা সকালে সংসারের কাজ শেষ করে দলবেঁধে বাগানে যান। সারা দিন দাঁড়িয়ে বাগানে কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন। সমাজের সব পেশার নারীরা কম-বেশি সম্মান পেলেও চা শ্রমিক নারীরা আজীবন উপেক্ষিত। ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, সুপেয় জল, স্যানিটেশনসহ অনেক আধুনিক সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত।

চা শ্রমিকরা ২০০৭ সালে মজুরি পেতেন ৩২ টাকা। ২০০৯ সালে ১৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৪৮ টাকা। ২০১৩ সালে বেড়ে হয় ৬৯ টাকা। এভাবে একটু একটু করে বেড়ে বর্তমানে মোটে ১৭০ টাকায় ঠেকেছে। ঠিকমতো খাবারের চাহিদা তো মেটেই না তাদের। ফলস্বরূপ ভোগেন নানা অসুখ-বিসুখে। বাগান এলাকায় সরকারিভাবে হাসপাতাল না থাকায় চা শ্রমিকরা স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হন। বাগান পরিচালিত স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসেবা খুবই সীমিত। অসুস্থ শরীরে দিনভর কাজ করে প্রায়ই হাঁপিয়ে ওঠেন তারা। অথচ তাদের উৎপাদিত চা পৃথিবীর ২৫টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। সব নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার তাদের প্রাপ্য। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তারা বৈষম্যের শিকার বলে জানান। চা বাগানের প্রতিটি নারী শ্রমিকই চান তাদের জীবন কষ্টে অতিবাহিত করলেও তাদের সন্তান যেন ভালো থাকে।

লালচান চা বাগানের নারী শ্রমিক চৈতালী বাউরী জানান, চা গাছ যেমন বাড়তে দেওয়া হয় না তেমনি চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়েঘরে বন্দি তাদের জীবন। বছরে কত দিবস আসে আর যায়, এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। তাদের চিন্তা জোঁক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে দিনশেষে চা পাতা নিয়ে মালিকের কাছে হাজিরা দেওয়া। তাদের চিন্তা ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম কীভাবে পার হবে।

দেউন্দি চা বাগানের বাবুল সাঁওতাল বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন মজুরিতে কাজ করা শ্রমিক আছে বলে মনে হয় না। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। মাথায় ছই (ছাতা) আর পেছনে ঝাঁকি নিয়ে বাগানে যেতে হবে। দিবস আমাদের পেটে ভাত দেবে না, কুঁড়ি তুললেই তবে ভাত জুটবে।

চা শ্রমিক নারী নেত্রী খায়রুন আক্তার জানান, চা শ্রমিকের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে একাধিক সময় আমরা আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু তারপরও চা শ্রমিকরা উপেক্ষিত। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে একজন শ্রমিকের মজুরি হিসাব করলে কোনোভাবেই মেলে না। আমরা চাই বাজারমূল্যের সঙ্গে চা শ্রমিকের মজুরি সমন্বয় করা হোক।

তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক ইমদাদুল হক বলেন, হবিগঞ্জে চা শিল্পের সঙ্গে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক জড়িত। পাতার মূল্য আর আমাদের সামর্থ্যরে সঙ্গে সমন্বয় রেখে তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়।

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close