ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

কেন বৃক্ষরোপণ করবেন
প্রকাশ: রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১:৫০ এএম  (ভিজিট : ৭৬২)
সারা দেশে চলছে তাপপ্রবাহ। অসহনীয় গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। ইট-কাঠের শহরের পাশাপাশি তেতে উঠেছে গ্রামের পরিবেশও। ফলে কিছুটা টনক নড়েছে নাগরিকদের। বলা যায়, নড়েচড়ে বসেছেন অনেকেই। এখনই গাছ লাগাবেন। কারণ এই খরতাপের জন্য দায়ী করা হচ্ছে বৃক্ষনিধনকে। আসলেও তাই। যুগের পর যুগ গাছ কেটে শহর বানানোর ফল তো এখনই ভোগ করতে হবে। সেই সবুজ বনানী ফিরে পেতে আরও ৫৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো, এখনও বিভিন্ন কারণে মানুষ গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করছে। বাড়ি, কারখানা, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছে। ফলে তাপপ্রবাহের যন্ত্রণায় সবাই এখন গাছ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। 

এই গাছ লাগানো নিয়ে আবার মতভেদও তৈরি হয়েছে। অনেকে আবেগী কথা বলছেন। এই তাপপ্রবাহে গাছ রোপণ করে তা বাঁচানো যাবে কি? যে পরিমাণ গাছ আমরা বছরের পর বছর হারিয়েছি; সেই পরিমাণ গাছ কি এক বছরেই লাগাতে পারব? বা এখন লাগালেই কি সঙ্গে সঙ্গে ফল পাব? পাব না। তবে উদ্যোগটা এখনই নিতে হবে। তাই কেউ কেউ গাছ লাগিয়ে বিশ্ব রেকর্ডও করতে চাইছেন। কোনো কোনো সংগঠন ইতিমধ্যেই বৃক্ষরোপণ করতে নেমে পড়েছে। তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আমি আশা করব, এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক। মৌসুম বা সময়োপযোগী বৃক্ষ সারা বছরই রোপণ করা যেতে পারে। 

তবে তার আগে কিছু বিষয় আমাদের জেনে নিতে হবে। তা হলো কোথায় কোন গাছ লাগাতে হয়। জানতে হবে কখন গাছ রোপণের উপযুক্ত সময়। এমনকি কোন গাছ কেমন উপকারে আসবে। একটি পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি প্রতি বছর পালিত হলে আগামী প্রজন্ম হয়তো সেই সুফল ভোগ করতে পারবে। তারা আমাদের মতো পূর্বপুরুষদের গাছ কাটার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারবে না। 

কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন-জুন, জুলাই ও আগস্ট গাছের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তাই সঠিক স্থানে সঠিক চারা রোপণের সময় এটি। বৃক্ষমেলা কিংবা নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করা যায়। তবে ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা লাগানোর প্রতি বেশি নজর দেওয়া উচিত। এতে ফল, ওষুধ এবং কাঠ সবই পাওয়া যায়। তাই গাছ লাগানোর আগে পরিকল্পনা করা জরুরি। এমনকি বন্যামুক্ত, আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে এবং সূর্যালোক পড়ে এমন জায়গায় চারা রোপণ করা উচিত। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, কারখানা, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে ও আশপাশে গাছ লাগাতে হবে। এমন স্থানে দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, তাল, খেজুর, নিম, পাম, ঝাউ, কৃষ্ণচূড়া, আম, কাঁঠাল, লিচুগাছ রোপণ করতে হবে।

শহর বা গ্রামের পাকা বাড়ির ছাদে টবে করে গাছের চারা রোপণ করা যায়। এখানে কমলালেবু, পেয়ারা, বরই, জাম্বুরা, ডালিম, মেহেদি, লিচু প্রভৃতি গাছ লাগাতে হবে। তবে বাড়ির দক্ষিণ পাশে রোদ ও আলোর জন্য ছোট এবং কম ঝোপালো গাছ লাগাতে হবে। সুপারি, নারিকেল, নিম, দেবদারু, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা, ডালিম, মেহেদি গাছ লাগানো যেতে পারে। বাড়ির পূর্ব-পশ্চিমে মাঝারি উঁচু এবং মাঝারি ঝোপাল গাছ লাগাতে হবে। এতে সকাল-সন্ধ্যা বাড়ির আঙিনায় আলো থাকবে। এখানে বাউকুল, আপেলকুল, সফেদা, আম্রপালি, লিচু, খেজুর, ডালিম, কলা, আতা, বেল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন গাছ রোপণ করতে হবে। 

বাড়ির উত্তর পাশে বড় ও উঁচু গাছপালা থাকলে ঝড়-তুফান প্রতিরোধ হয়। এখানে আম, কাঁঠাল, জাম, কামরাঙা, মেহগনি, শিশু, সেগুন, হরীতকী, আকাশমণি, বাঁশ ইত্যাদি গাছ রোপণ করতে হবে।

আশপাশের পতিত জমিতে আম, কাঁঠাল, জাম, কামরাঙা, মেহগনি, শিশু, সেগুন, হরীতকী, আকাশমণি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, ঝাউ, কৃষ্ণচূড়া, বাঁশ ইত্যাদি গাছ রোপণ করা উচিত। আর হাট-বাজারে ছায়াদানকারী গাছ রোপণ করা উচিত। এসব জায়গায় আম, কাঁঠাল, জাম, সেগুন, দেবদারু, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, কৃষ্ণচূড়া, বটগাছ রোপণ করা যায়। রাস্তার পাশে উঁচু ও ডালপালা ছাঁটাই করা যায় এমন গাছ রোপণ করতে হবে। এসব জায়গায় মেহগনি, শিশু, সেগুন, হরীতকী, আকাশমনি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, ঝাউ, কৃষ্ণচূড়া, বাবলা, ইপিল ইপিল, শিমুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।

একইভাবে পথের দুপাশে বা ফিডার রোডের পাশে শিশু, নিম, দেবদারু, চম্পা, ইপিল ইপিল, পাইন্যাগোলা বা লুকলুকি, মান্দার, পালিত মাদার, পানিয়া মাদার, বাবলা, খয়ের, বকফুল, তাল, খেজুর ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে। তবে বড় রাস্তা বা মহাসড়কের পাশে কৃষচূড়া, কনকচূড়া, রেইনট্রি, গগন শিরীষ, রাজকড়ই, শিলকড়ই, শিশু, মেহগনি, অর্জুন, দেবদারু, সোনালু, নিম, নাগেশ্বর, আকাশমনি, বকুল, পলাশ, তেলসুর, ঝাউ, বটল পাম প্রভৃতি গাছ লাগানো জরুরি। এ ছাড়া রেললাইনের পাশেও গাছ লাগানো উচিত। এসব স্থানে মেহগনি, শিশু, সেগুন, আকাশমনি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর, নিম, পাম, শিমুল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা যায়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাঁধের ধারে শেকড় শক্ত এবং বিস্তৃত এমন গাছ লাগানো যেতে পারে। বাঁধের পাশে বট, আমড়া, বাঁশ, মেহগনি, শিশু, সেগুন, আকাশমনি, দেবদারু, নারিকেল, সুপারি, খেজুর ইত্যাদি গাছ রোপণ করা দরকার। জমির আইলে যেসব গাছের শেকড় কম বিস্তৃত, কম ছায়াদানকারী, ডালপালা ছাঁটাই করা যায় এমন গাছ লাগাতে হবে। জমির আইলে মেহগনি, দেবদারু ইত্যাদি গাছ রোপণ করতে হবে। জমির ভেতরেও গাছ লাগানো যায়। 

দেশের বরেন্দ্র এলাকায় ধানের জমিতে মাটির ঢিবি তৈরি করে সেখানে ব্যাপক হারে আমগাছ লাগানো যায়। এমনকি জমির আইলেও অনেক গাছ লাগানো যায়। অনেক জায়গায় আইলে তালগাছ লাগিয়ে বাড়তি লাভ পাওয়া যায়। তালগাছ ছাড়াও খেজুর, সুপারি, বাবলা, বকাইন, জিগা, কড়ই, ইউক্যালিপটাস, পালিত মাদার ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে। আবার নিচু জমিতে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে এমন গাছ রোপণ করা জরুরি। পিটালি, বেত, মূর্তা, বাঁশ, মান্দার, জারুল, হিজল, কদম ইত্যাদি গাছ নিচু জমিতে রোপণ করা যেতে পারে।

বাড়ির পুকুরপাড়ে মাটি ভাঙে না এবং শোভাবর্ধন করে যেমন-সুপারি, নারিকেল, নিম, দেবদারু, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, ডালিম ইত্যাদি গাছ লাগানো যায়। নদীর তীরে পানিসহিষ্ণু, শক্ত, মজবুত ও বড় হয় এমন গাছ রোপণ করা উচিত। এমন জায়গায় শিমুল, ছাতিম, পিটালি, বেত, বাঁশ, মূর্তা, মান্দার, জারুল, হিজল, কদম ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে। বিল এলাকায় যেখানে বছরে দুই-তিন মাস পানি জমে থাকে; সেখানে হিজল, করচ, বিয়াস, পিটালি, জারুল, মান্দার, বরুণ, পলাশ, কদম, চালতা, পুতিজাম, ঢেপাজাম, রয়না বা পিতরাজ, অর্জুন ইত্যাদি গাছ লাগানো যায়।

উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন জেগে ওঠা চরে কেওড়া, বাইন, কাঁকড়া, গরান, গোলপাতা গাছ লাগানো যায়। তবে উপকূলে যেসব চর একটু উঁচু ও স্বাভাবিক। জোয়ারের পানি ওঠে না। সেসব চরে বাবলা, ঝাউ, সনবলই, সাদা কড়ই, কালো কড়ই, জারুল, রেইনট্রি ইত্যাদি লাগাতে হবে। উপকূল ছাড়া অন্য অঞ্চলে নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ঝাউ, লোনাঝাউ, পিটালি, করচ, পানিবিয়াস লাগানো যেতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে, হালকা পাতাবিশিষ্ট গাছ যেমন-সুন্দরী, ছৈলা, গরান, গেওয়া, গোলপাতা, মান্দার, কড়ই, বাবলা, নারিকেল ইত্যাদি গাছ রোপণ করা উচিত।

এ ছাড়া উঁচু পাহাড়েও বৃক্ষরোপণ করা যায়। অনেক পাহাড়ি জমিতে কমলালেবুসহ বিভিন্ন প্রজাতির লেবু, লিচু, আম, পেয়ারা, গোল মরিচ, আদা, আনারসের সফল বিস্তার ঘটানো সম্ভব। তা ছাড়া তেলসুর, চাপালিশ, চিকরাশি, শিলকড়ই, গর্জন, গামার, সেগুন, ইপিল-ইপিল, বাঁশ, কাজুবাদাম প্রভৃতি কাঠের চাহিদা মেটাতে পারে পাহাড়ের বৃক্ষরোপণ। সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য হলেও ফুটপাথে, ডিভাইডারে ফুলগাছ লাগাতে হবে। তাই একটি গাছ কাটলে অন্তত দশটি গাছ লাগানো উচিত। মনে রাখতে হবে, জীবনই যদি না বাঁচে, তা হলে বসতবাড়ি গড়ে কী লাভ?

তাই আমরা আশা করব, সবাই মিলে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে বৃক্ষরোপণ করা হোক। বর্ষা মৌসুমে আমরা বেশি বেশি গাছ লাগাব। সময়োপযোগী পরামর্শ দিয়ে সবার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো জরুরি। গাছ লাগানোর জন্য সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে স্ব স্ব উদ্যোগে এই প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে। সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি নাগরিককে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। 

তাপপ্রবাহ রোধে ভূমিকা রাখতে হবে। তাই আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। বৃক্ষ রোপণের প্রস্তুতি নিন এখনই। প্রকৃতি বাঁচান, নিজে বাঁচুন। কেননা প্রকৃতি বাঁচলেই তো মানুষ বাঁচবে। 


কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close