ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

এবারই হতে পারে এরদোগানের শেষ নির্বাচন
প্রকাশ: সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০২৪, ১:১২ এএম  (ভিজিট : ৫৩৪)
তুরস্কের বাসিন্দারা রোববার স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের পরবর্তী লক্ষ্য দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ইস্তানবুলের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়া। এমন সময় স্থানীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যখন দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬৭ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে এবং ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান একেবারে তলানিতে ঠেকেছে।

দুই দশক সময় ধরে ক্ষমতা এবং এক ডজনেরও বেশি নির্বাচনের পর, তুরস্কের কর্তৃত্ববাদী নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান জানেন কীভাবে সবকিছু সামাল দিতে হয়। অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরের মতোই তিনি জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এর আগের নির্বাচনে তুর্কি ভোটাররা যখন নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়েছিলেন, সে সময় তারা তাদের মানিব্যাগের অবস্থার কথা বিবেচনা করে ভোট দেননি। তুরস্কে খাবারের দাম তখনও আকাশছোঁয়া। ৪৩ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির কারণে অবস্থা ছিল অসহনীয়। এই অবস্থার পরও প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোান, যিনি তুরস্কের অর্থনীতি এবং বাকি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এই ঘটনায় বিশ্লেষকরা বেকুব বনে গেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ এক শিক্ষালাভ করেছেন : ‘জনমত জরিপের ফলাফল থেকে সাবধান।’

মেট্রোপলিটন পৌরসভা, শহর ও জেলা মেয়রের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসক নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে ১০ লাখই প্রথমবার ভোট দিচ্ছেন। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সারা দেশে কমপক্ষে ৫ লাখ ৯৪ হাজার নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন রয়েছে। এক কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার শহর ইস্তানবুলেই জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠেছেন ৭০ বছর বয়সি এই তুর্কি নেতা। ১৯৯৪ সালে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহরটির মেয়র নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। আর এবারের নির্বাচনে শহর দুটিতে একে পার্টি জিতলে বর্তমান মেয়াদ ২০২৮ সালের পরও, এরদোগান প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকার সুযোগ তৈরি করতে পারবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

১৯৯৪ সালে ইস্তানবুলের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন এরদোগান। সে সময় থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি ও তার মিত্ররা ইস্তানবুল শাসন করে এসেছে। তবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর সে বছর রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) প্রার্থী একরাম ইমামোগলু মেয়র নির্বাচিত হলে এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের প্রশাসনিক ক্ষমতা এরদোগানের হাত থেকে বের হয়ে যায়। বিশ্লেষকদের মতে, ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের ইস্তানবুলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার আশা ছাড়েননি এরদোগান। শহরটি রক্ষণশীল মুসলিম ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে এরদোগানের জন্যেও ইস্তানবুল একটি মান-সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক বিশ্লেষক বলেন, ইস্তানবুল তুরস্কের রাজনীতির সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

এরদোগান নিজেও একবার বলেন, ‘যে ইস্তানবুলে জিতে, সে তুরস্ক জিতে নেয়।’ এবারের ভোটে এরদোগানের দলের পক্ষে সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মুরাত কুরুম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ২০২৮ সালে এরদোগানের প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ শেষে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ইস্তানবুলের বর্তমান মেয়র ইমামোগলু। তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে মেয়রের পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বলছেন বিশ্লেষকরা।

এই নির্বাচন হতে পারে এরদোগানের জন্য আরেকটি পরাজয়। সিএইচপি দলের প্রার্থীরা জনমত জরিপে অল্প ব্যবধানে এরদোগানের দলের চেয়ে এগিয়ে আছে। বিশেষত, রাজধানী আঙ্কারা, ইস্তানবুল ও বন্দরনগরী ইজমিরে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের তুরস্ক বিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক সোনার কাপাগতায় বলেন, এরদোগানের প্রার্থীরা তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে জিততে না পারলে ‘এরদোগানের রাজনৈতিক দৈন্য’ প্রকট হবে। 

২০০৩ সালে সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন এরদোগান। এর পর থেকে টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তুরস্কের ক্ষমতার শীর্ষে আছেন এই শাসক। বিরোধী দল জয়ী হলে ইমামোগলু একজন গ্রহণযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে এটাই হতে পারে এরদোগানের শেষ নির্বাচন। এ মাসের শুরুতে এরদোগান জানান, এই স্থানীয় নির্বাচনই তার শেষ নির্বাচন হতে পারে। যার ফলে তার দুই দশকের শাসনামলের অবসান হতে পারে বলে ভাবছেন বিশ্লেষকরা। তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক এরদোগানের এই বিদায়ি বার্তাকে রাজনৈতিক ছল হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, এরদোগান এই বাণীর মাধ্যমে ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছেন।

তুরস্কের কুর্দিপন্থি দল ডিইএম পার্টি ৬০০ সদস্যের পার্লামেন্টে তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। ২০১৯ সালের মেয়র নির্বাচনে দলটি ইমামোগলুকে নীরব সমর্থন দেয়। সেবার কোনো প্রার্থী না দিলেও এবার দলের পক্ষ থেকে দুইজন প্রার্থী ইস্তানবুলের মেয়র পদের জন্য লড়বেন। কুর্দিরা ইস্তানবুলের ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ২০ মার্চ স্পেকট্রাম হাউস পরিচালিত এক মতামত জরিপে জানা গেছে, ডিইএম দলের সমর্থকদের প্রায় অর্ধেক ইমামোগলুকে সমর্থন জানাবেন।

রোববারের নির্বাচনে তুরস্কের ভোটারদের মেয়রের পাশাপাশি প্রাদেশিক কাউন্সিল সদস্য ও অন্যান্য স্থানীয় কর্মকর্তাদেরও ভোটের মাধ্যমে বেছে নিতে হবে। ইস্তানবুলের ব্যালট পেপারে ৪৯ জন প্রার্থীর নাম রয়েছে এবং এটি প্রায় ৯৭ সেন্টিমিটার লম্বা। কিন্তু এতজন প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ভোটারদের নিস্পৃহ মনোভাবে পরিবর্তন আসেনি।

গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু বিরোধী পক্ষের ভোটাররা অনুভব করেন, দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করা ও সরকারে পরিবর্তন আনার সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে। এমন কী, সরকারি দলের সমর্থকরাও রাজনীতিবিদদের ওপর ভরসা রাখেন না। তারা মনে করেন, এই রাজনীতিবিদদের দেশের জনমানুষের জীবনের মান উন্নয়ন করার সক্ষমতা নেই। 

সিটি ও মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন হলেও এ ভোটাভুটিকে দেখা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের জন্য অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলেও ২০১৯ সালের স্থানীয় নির্বাচনে তার দল একে পার্টির হাতছাড়া হয়ে গেছে রাজধানী আঙ্কারা ও বড় শহর ইস্তানবুল। এতে শহর দুটির প্রশাসনিক ক্ষমতাও বেরিয়ে যায় প্রেসিডেন্ট এরদোগানের হাত থেকে। এবার শহর দুটিতে জিতে প্রশাসনিক ক্ষমতা ফিরে পাওয়াই চ্যালেঞ্জ এরদোগানের জন্য।

৭০ বছর বয়সি তুর্কি নেতা ইস্তানবুলেই জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠেছেন। ১৯৯৪ সালে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহরটির মেয়রও হয়েছিলেন এরদোগান। ২০১৯ সালের নির্বাচনে এরদোগানের প্রার্থী ও তৎকালীন মেয়র বিনালি ইলদিরিমকে হারিয়ে মেয়র হন বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) প্রার্থী একরাম ইমামোগলু। এবার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রত্যাশী ইমামোগলুর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এরদোগানের দল একেপির প্রার্থী সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মুরাত কুরুম।

আগেরবার তুর্কি পার্লামেন্টে তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কুর্দিপন্থি ডিইএম পার্টি এমামোগলুকে সমর্থন দিয়েছিল। এবার তারা নিজেরাই প্রার্থী দিয়েছে। তাই এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখছে একেপি। এদিকে আঙ্কারায় বর্তমান মেয়রও এরদোগান বিরোধী দলের। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রত্যাশী মেয়র মনসুর ইয়াভাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে একে পার্টির প্রার্থী তুরগুত আলতিনো। 

কহর দুটির নেতৃত্বে ফেরাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ক্ষমতাসীন একে পার্টি। এ ভোটকে দেখা হচ্ছে এরদোগানের জনপ্রিয়তার একটি ব্যারোমিটার হিসেবে। শহর দুটিতে একেপি জিতলে বর্তমান মেয়াদ ২০২৮ সালের পরও প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকার সুযোগ তৈরি করতে পারবেন এরদোগান।ভোটের প্রাথমিক ফল রাত ১০টয় প্রকাশ করা হতে পারে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। 

প্রধান শহরগুলোতে নির্বাচনে জয়লাভ করা বিরোধীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন তুরস্কের ওজিগিন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইভরেন বাল্টা। বিদেশি তহবিলে প্রবেশাধিকার, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই এই শহরগুলোর গুরুত্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

প্রশ্ন হলো, তুরস্কের অর্থনীতিতে এক বড় সংকট থাকার পরও কেন বেশিরভাগ ভোটার এরদোগানকেই বেছে নিলেন? গত ফেব্রুয়ারিতে দেশজুড়ে বিপর্যয়কর জোড়া ভূমিকম্প, যাতে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, সেই ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রবল সমালোচনার পরও ভোটাররা কেন তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন না? যিনি ইস্তানবুলের কাদির হ্যাস ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সোলি ওজেল বলছেন, ‘আমি মনে করি তিনি একজন চূড়ান্ত ‘ “টেফলন রাজনীতিবিদ”, কোনো অভিযোগ যার গায়ে বসতে পারে না’। তিনি আরও বলেন, ‘তার যে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রয়েছে, এটা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। তার শরীর থেকে ক্ষমতার আভা বের হয়।’

সাংবাদিক 

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close