ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

কবি, কবিতা ও স্বাধীনতা
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১:০০ এএম  (ভিজিট : ৩৫২২)

পৃথিবী হেসে ওঠে জীবনের ছন্দ পেলে। সেই জীবনকে পর্বে-পার্বণে ভাগ করে নেয় মানুষ। কখনো ধর্মে, কখনো বর্ণে, কখনো ভাষায়। এভাবেই মানুষ ভাগ হয়ে যায় নিজের মানব অস্তিত্ব ভুলে। কিন্তু যখন একটি ভূখণ্ডের কথা আসে, স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা আসে, তখন সেই মানুষ সব ভুলে একত্রিত হয়। উদ্বেলিত হয়, আন্দোলিত হয়। বহু মত তখন এক মন্ত্রে একত্রিত হয়। আর এর মূলে কাজ করে তার নিজস্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এবং হয় ওঠে প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু। সে সময় কবিতা আর কবিরাই হন প্রেরণার চাবিকাঠি। তাই তো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য কবিতা অস্ত্রস্বরূপ।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কি কবিরা পিছিয়ে ছিলেন? মোটেই না, বরং তাদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। বিশ্বে যখন কবি ও কবিতা মুক্তি ও স্বাধীনতার মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে ওঠে, বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রে অনন্য। স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশে কবিতার ছিল প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবিদের একজন শামসুর রাহমান তো স্বাধীনতা নিয়ে লিখেছেন তার কিংবদন্তিতুল্য যুগল কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’। কবিতা দুটিতে প্রতিবাদকে সুর করে স্বাধীনতার ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে। তারই কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দিশিবির থেকে’-এর প্রায় প্রতিটি কবিতায় বন্দিত্ব থেকে স্বাধীন হওয়ার আকুতি রয়েছে। ‘তুমি বলেছিলে’ শিরোনামে কবিতায় তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন যেন-
‘অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। 
আর্ত শব্দ সবখানে। 
আমাদের দু’জনের মুখে খরতাপ। 
আলিঙ্গনে থরো থরো 
দাউ-দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।’ 
বিখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করে-‘কবিতা হইল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার। কবিতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির অস্ত্র।’
কবিরা জন্ম থেকেই স্বাধীন। তাই তারা কলমের সঙ্গে অস্ত্রও হাতে তুলে নিতে জানেন। স্বাধীনতা কী শুধুই ভূখণ্ডে আবদ্ধ থাকে! স্বাধীনতা শব্দের সামগ্রিকতা লুকিয়ে থাকে চেতনায়।  
চে গুয়েভারা যে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন তা ছিল সারা বিশ্বের শোষিত মানুষের জন্য। তারও হাতে উঠেছিল অসি এবং মসি দুই-ই। তার চাওয়া স্বাধীনতা ছিল বিশ্ব স্বাধীনতা। তাই তো তার কবিতায় উঠে আসে-
‘চলো যাই 
অগ্নিময় প্রত্যুষে 
বালুকাময় আঁকাবাঁকা নির্জন পথ পেরিয়ে 
তোমার ভালোবাসার সবুজ স্বপ্নময় 
দেশের মুক্তির জন্য। 
চলো যাই জমাটবাঁধা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে 
আমাদের ললাটে অসংখ্য বিদ্রোহের তারা জ্বলছে 
শপথের অগ্নিতে না হয় আমরা মরবো 
অথবা জিতবো...। 
(ফিদেলের জন্য কবিতা, ফিদেল কাস্ত্রো, যিনি ছিলেন চে’র খুব ভালো বিপ্লবী বন্ধু।)  
কবিরা মৌন থাকলেও স্বাধীনতা আর মুক্তির পক্ষেক্ষ কতটা ভয়ংকর হতে পারেন, তার আরেক প্রকৃত প্রমাণ চিলির কবি পাবলো নেরুদা। নেরুদা ছিলেন কমিউনিস্টপন্থি। তার কবিতায় সমাজতন্ত্র এতটাই উজ্জ্বল রূপ পেয়েছিল যে, যখন তিনি হাসপাতালে ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে মারা যান, তখন স্বৈরাচারী পিনোশে কবির শেষকৃত্যের অনুমতি দেয়নি; বরং উল্টো সান্ধ্য আইন জারি করে। কিন্তু মুক্ত মনের লাখ লাখ বিপ্লবী জনতা সেই সান্ধ্য আইন অমান্য করে কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। 
এবং সেই সমাবেশ হয়ে যায় পিনোশের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চিলির জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রথম বিক্ষোভ।  আর এভাবেই জয়লাভ করে কবি ও কবিতা।
আবারও বলতে হচ্ছে কবিরা জন্ম থেকেই স্বাধীন। তাই পরাধীনতার সব অসভ্যতা তারাই প্রথম টের পায়। আবার সেই কবির কলমই হয়ে ওঠে স্বৈরাচারের জন্য মারণাস্ত্র। চে’র আগেও অনেক কবি অসি হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তাদেরই একজন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি ভিত কাঁপিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনের তার বিদ্রোহী কবিতার অস্ত্রে। তিনি যখন বলে- 
বল বীর 
আমি চির উন্নত শির! 
আমি চির দুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, 
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, 
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
সত্যিই তো, তিনি যদি মহাপ্রলয় হয়ে না উঠতেন, তাহলে তার কবিতায় তার কবিত্বে আঘাত কেন? তাই তো সারণি করে লিখলে লিখতে হয়- প্রথমে কবি, পরে কবিতা এবং তারপরেই স্বাধীনতা। 
রুশ কবি ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো বলেন, ‘কবিতা পাখির মতো, এটি সমস্ত সীমান্তকে উপেক্ষা করে।’ তার বিখ্যাত কবিতা ‘যুদ্ধের দিনে বিয়ে’ কবিতায় হিটলারকে নিয়ে লেখেন-  দেয়ালের ওপর থেকে উড়তে থাকে সেøাগান মতো/ হিটলার শেষ হয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে!/ তবু কনেবউয়ের গাল পুড়ে যায় তপ্ত অশ্রুতে। 
বিশ্বে যেসব স্থানে কবি ও কবিতা মুক্তি ও স্বাধীনতার মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে অনন্য। স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশের কবিতার ছিল প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। শামসুর রাহমানের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখলেন- ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’। কবিতায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে তিনি করলেন  অলংকৃত। তিনি লিখলেন, একটি কবিতা লেখা হবে 
তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লাখ লাখ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে, গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কবির চোখে লক্ষ্যভেদী কবিতা হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। 
আরেক কবি আসাদ চৌধুরী লিখলেন ‘রিপোর্ট ১৯৭১’-
‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল 
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম 
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো। 
এসব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে সরে যায়, একডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী করে 
হয়তোবা উঠেছিলো কেঁদে। 
বাংলার স্বাধীনতার জন্য তাঁর কলম আঁকলো বাংলার নারীদের আত্মত্যাগ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যতই বেগবান হয়েছে, ততই ক্ষুরধার হয়েছে বাংলার কবিদের লেখার গতি। স্বৈরাচারীর চরম অত্যাচারে নারী, শিশু কারো রক্ষা ছিল না। কবি আবুল হাসান তার ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ কবিতায় আঁকলেন সেই ছবি- 
‘লক্ষ্মী বউটিকে 
আমি আজ আর কোথাও দেখি না, 
হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে কোথাও দেখি না 
নরোম নোলক পরা বোনটিকে 
আজ আর কোথাও দেখি না! 
কেবল পতাকা দেখি, 
কেবল উৎসব দেখি, 
স্বাধীনতা দেখি 
তবে কি আমার ভাই আজ 
ঐ স্বাধীন পতাকা? 
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব? 
কবিতার শক্তিশালী রূপ দেখেছিলেন পৃথিবীবিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি বলেছিলেন, ‘চিত্রাঙ্কন অনুভূতির পরিবর্তে দেখা যায় এমন কবিতা এবং কবিতা এমন চিত্রকর্ম যা দেখার চেয়ে বেশি অনুভূত হয়।’ অর্থাৎ কবিতা অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে, মানুষকে প্রতিবাদী করে গড়ে তোলে। 
আমাদের আরেকজন প্রধান কবির কবিতা দিয়ে শেষ করব। স্বাধীনতার জন্য যারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেসব বীরের হয়ে নিজের সন্তানকষ্টে কবি সুফিয়া কামাল উচ্চারণ করেন-
‘এই পৌষের শীতজর্জর রাত কাটে আর শিশির ঝরে 
 মোর যাদুদের সমাধি ’পরে। 
 মায়ের চোখের, বধূর চোখের মতন তারা 
মাটিতে চাহিয়া আত্মহারা, 
ন’মাস কেটেছে এ দেশের মাটি তাজা তাজা খুনে সিক্ত হয়ে, 
উর্বর হয়ে এসেছে লয়ে 
মৌসুমি ফুল ধানের গন্ধ মিঠা সোনা রোদ বাংলাদেশ  
কবিতা উচ্চারণে চোখে নেমে আসে অশ্রু।  এই তো স্বাধীনতা, এই তো কাব্য এবং এটাই শক্তি হয়ে ওঠে স্বাধীনতাকামীদের। কবিতার শক্তিই পারে যুগে যুগে শাসক-হৃদয়ে কাঁপন লাগাতে।
স্বাধীনতার প্রেরণা জড়িত অনেক কবি ও কবিতার কথা বললাম। কিন্তু যে কবি ও কবিতার কথা না বললে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার কথা অপূর্ণই থেকে যাবে, তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তার কবিতা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ যে কবিতায় নেচে উঠত বাঙালির হৃদয়।
যে কবিতার প্রতিটি কথায় ফুটে ওঠে বাংলার সবুজ ছবি। স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচাইতে প্রিয় গানটিই হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। 
একই সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটি হয়ে গেল আমাদের রণসংগীত।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close