ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবতে হবে
প্রকাশ: শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০২৪, ২:৫৮ এএম আপডেট: ২২.০৩.২০২৪ ৩:২৬ এএম  (ভিজিট : ৪৮৭)
দেশে শিল্প-কারখানায় বড় ধরনের দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর খতিয়ান বেশ লম্বা। প্রতি বছর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে মারা যাচ্ছে বহু কর্মরত শ্রমিক। একই কারণে কর্মস্থলের আশপাশের মানুষের মৃত্যুও কম ঘটেনি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৪ জন মানুষের মৃত্যু পুরো পোশাক শিল্পের সম্ভাবনার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় সেদিন আহত হন ২ হাজার ৫০০ জন শ্রমিক। এর আগে রাজধানীর তাজরীন ও স্পেকট্রাম গার্মেন্টসে ভয়াবহ দুর্ঘটনা এবং অসংখ্য শ্রমিকের করুণ মৃত্যু শিল্প-কারখানায় শ্রমিকের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

২০১১ সালের ২১ জুলাই রাজধানীর কাকরাইলে আইরিশ-নুরজাহান টাওয়ার নামের একটি নির্মাণাধীন ১৭ তলা ভবনের লিফটে করে নির্মাণসামগ্রী ওঠানোর সময় লিফটের তার ছিঁড়ে চার নির্মাণ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। রাজধানীর র‌্যাংগস ভবন ভাঙার কাজে নিয়োজিত থেকে অনেক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু সংস্থার দায়িত্বহীনতার প্রমাণ। নিরাপত্তাহীনতার অভাবে কর্মস্থল ছোটখাটো দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর তো হিসাবই নেই। গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মগবাজারের দিলু রোডে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের স্টিল ফ্রেমের একটি অংশ ভেঙে মাথায় পড়ে ৫০ বছরের এক ব্যক্তি মারা যান। এর পরদিন তেজগাঁওয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্রেন থেকে কন্টেইনার পড়ে ৩৯ বছরের একজন শ্রমিক প্রাণ হারায়। ইতিপূর্বে রাজধানীর মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে কর্মরত অবস্থায় নিচে পড়ে এক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু, নির্মাণাধীন আরেকটি ভবন থেকে মাথায় রড পড়ে এক পথচারী শিশুর মৃত্যু দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে।

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশেনের সমীক্ষায় জানা যায়, গত এক দশকে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৯ হাজার ২৬৩ জন শ্রমজীবী মানুষের। সবশেষ ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে মারা গেছে ১ হাজার ৪৩২ জন, যা ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ।

দ্রুত নগরায়ণের কারণে বাংলাদেশে চলছে নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরির কাজ। দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল, টানেল নির্মিত হচ্ছে দেশজুড়ে। দেশের শ্রমিকের ঘামের বিনিময়ে বেড়ে ওঠে একেকটি গগনচুম্বী ইমারত। এগিয়ে চলে দেশের অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এসব কাজ যেমন ব্যয়বহুল তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ নিরলস কাজ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাদের জীবনের বিনিময়ে গড়ে ওঠে দেশ-বিদেশের বড় বড় শিল্প-কারখানা, রচিত হয় নগর সভ্যতা। দেশের পরিবহন শিল্প, নির্মাণ শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিক বেঁচে থাকার তাগিদে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে যান। 

একসময় গার্মেন্টস শিল্প-কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ছিল যেন নিত্যদিনের ঘটনা। কারখানার ভেতরে কর্মরত অবস্থায় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে বহু শ্রমিককে প্রাণ দিতে হয়েছে। আগুন লাগলে কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানার গেট বন্ধ করে রাখায় শ্রমিকরা শতচেষ্টায়ও বের হয়ে আসতে পারেনি। হাঁটা-চলার অপ্রশস্ত পথ, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসহীন পরিবেশে কাজ করে তারা হন দুর্ঘটনার শিকার। অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে বহু শ্রমিক। 

কারখানার সরু সিঁড়ি বেয়ে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে আসতে পদদলিত হয়ে হতাহত হয়েছে অনেকে। নির্মাণ শিল্প খাতে একজন রাজমিস্ত্রি, রড বাঁধাইকারী বা সাধারণ শ্রমিককে অত্যন্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করে যেতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের জন্য সেফটি স্যু এবং টুপি সরবরাহ করে না নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংস্থা। শ্রমিকদের পরনে থাকে না কাজের উপযোগী পোশাক পরিচ্ছদ। এমনকি এসব শ্রমিকদের কিনে ব্যবহার করতেও বাধ্য বা উদ্বুদ্ধ করা হয় না। ফলে শ্রমিকদের মাথায় আঘাত বা পায়ে পেরেক ঢোকার মতো ছোটখাটো দুর্ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে থাকে। শ্রমিকদের জন্য নির্মাণ কাজে ওপরে ওঠার জন্য ব্যবহৃত মই ও মাচা থাকে নড়বড়ে। মাচা তৈরি করা হয় নাজুক কাঠ বা বাঁশ দিয়ে। বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয় পুরোনো দড়ি। কাজের স্থানের পাশে থাকে না কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী। ফলে মাচা ভেঙে বা দড়ি ছিঁড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে অহরহ। ওপর তলার ছাদ বা কার্নিশ থেকে শ্রমিকদের নিচে পড়ে হতাহত হতে শোনা যায়। 

কখনো নির্মাণাধীন উপরিকাঠামো ভেঙে মাথায় পড়ে মৃত্যু বা হাত-পা ভেঙে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়। এ ছাড়া শ্রমিকের নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করার কারণে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটজনিত দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায় কখনো কখনো। বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ায়, ভূ-অভ্যন্তরে কাজ করতে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বা দাহ্য পদার্থে আগুন লেগে শ্রমিকের মৃত্যু এ দেশে যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যু বা পঙ্গুত্ববরণের ফলে পরিবারে নেমে আসে ভয়াবহ আর্থিক সংকট ও সামাজিক অনিশ্চয়তা। অথচ অনেক ক্ষেত্রে আহত শ্রমিকের চিকিৎসা সাহায্য বা মৃত্যুবরণকারীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে এগিয়ে আসে না নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থা অকুপেশনাল সেফটি হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এবং শ্রম আইন বিধিমালা, ২০১৫-এ উল্লিখিত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধানের যথাযথ প্রয়োগের লক্ষ্যে পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা, পোশাক খাতের মতো অন্যান্য সেক্টরেও শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে সেফটি কমিটি গঠন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার বেলায় নিহত শ্রমিক পরিবারকে এককালীন ১০ লাখ টাকা এবং আহত শ্রমিককে ৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার বিষয়টি শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, শিল্প খাতের সব সেক্টরে এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম চালু করা, সরকারিভাবে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্যের সঠিক ডাটাবেজ তৈরি করা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহত শ্রমিকদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং মাসিক চাঁদা সরকারের পক্ষ থেকে প্রদান করা, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড এলাকায় অবস্থিত মালিকপক্ষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা এবং আধুনিকায়ন করা, কর্মস্থলে শ্রমিকদের উপযোগী ব্যক্তিগত উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করা, শিল্প মালিক ও ব্যবস্থাপকদের জন্য জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা-২০১৩ সম্পর্কে ওরিয়েন্টেশন প্রদান করা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইউনিট চালু করা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পেশাগত রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হ্রাস করে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা দানে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। 

প্রয়োজনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যেতে পারে। যেকোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি এড়াতে এবং তাৎক্ষণিক উদ্ধার কাজের জন্য ইমার্জেন্সি ইনসিডেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্লান করতে হবে। জরুরি উদ্ধার কাজের জন্য প্রকল্প এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স, ফাস্ট এইড ও জরুরি চিকিৎসক প্রস্তুত রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার বা আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণসহ আহতদের চিকিৎসাসেবা ছাড়া নির্মাণ কাজে শ্রমিকদের অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে না। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, জীবন নিরাপত্তার চেয়ে কারখানার মালিকদের অধিক মুনাফা লাভের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ফলে শ্রমিকের জীবনমান কখনো উন্নত হয় না। অথচ শ্রমিকের কাজের ওপর নির্ভর করে শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়ে থাকে। দেশে শিল্পায়নের বিস্তারে সঙ্গে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারখানার সংস্কার, বয়লার ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে শ্রমিক ও মালিক উভয়েই লাভবান হতে পারবে। এ ব্যাপারে কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর, শিল্প মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নিয়মিত তদারকি ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম জোগানদাতা তৈরি পোশাক শিল্প খাতে দুর্ঘটনা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। 

অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে তদারকি, নজরদারি নিশ্চিত করা হলে এর সুফল দ্রুত পাওয়া যাবে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল রেখে জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অসম্ভব। নিরাপদ কর্মপরিবেশ শ্রমিকের শুধু জীবন বাঁচায় না, উৎপাদনশীলতাও বাড়ায়। ফলে নিরাপত্তার জন্য ব্যয় বা বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে সংশ্লিষ্ট খাতের লাভ বয়ে আনে। শ্রমিক বাঁচলে উন্নত হবে শিল্প-কারখানা, সমৃদ্ধ হবে দেশ। শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণে রাষ্ট্র ও সমাজ সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close