ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

নষ্ট হচ্ছে বন্ধ চিনিকলের যন্ত্রাংশ
প্রকাশ: শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৩:৪০ এএম  (ভিজিট : ৭৮৮)
দেশে মোট সরকারি চিনিকল ১৫টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে ৬টি আর চালু আছে ৯টি। বন্ধ চিনিকলগুলোকে সব দিক থেকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। চালু চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোং ছাড়া অন্যগুলোকে বছর বছর গুনতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা লোকসান। এ ছাড়া বছরের 
পর বছর অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। এসব চিনিকলের ৪টির চিত্র তুলে ধরা হলো

লোকসানে বন্ধ কুষ্টিয়া চিনিকল : অর্থ সংকট ও দেনার দায়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৬০ বছরের পুরোনো কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী চিনিকল। টানা ৩ মৌসুম আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন বন্ধ রয়েছে চিনিকলটিতে। ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত চিনিকলটিতে লোকসান হয়েছে ৪৬১ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধের ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন এই শিল্পে জড়িত কৃষক ও শ্রমিকরা। বর্তমানে নষ্ট হচ্ছে কুষ্টিয়া চিনিকলের ভারী যন্ত্রপাতিসহ শতকোটি টাকার স্থাপনা। অন্যদিকে এখনও বকেয়া অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাচুইটি। বন্ধের সময় কুষ্টিয়া চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলেছিল, বিকল্প কলকারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে সেই আশ্বাস আশ্বাসই থেকে গেছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুষ্টিয়া চিনিকলে ২০২০-২১ মৌসুম থেকে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। এই মিলের দৈনিক মাড়াই ও উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৫০০ টন আর বার্ষিক মাড়াই ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার টন। কিন্তু বন্ধের ৩ বছর পরও মিলটি চালু করতে সরকার কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় মিলজোনের আওতায় আখ উৎপাদন মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে। টানা মৌসুম বন্ধ থাকায় চিনিকলের অভ্যন্তরে সুনসান নীরবতা। মিলের শতাধিক কোয়ার্টারও বর্তমানে পরিত্যক্ত। 

জনবল কাঠামো অনুযায়ী কুষ্টিয়া চিনিকলে ১ হাজার ৭৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বর্তমারে ৬৬ জন মিলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন। এদের মধ্যে ৫ জন কর্মকর্তা, ২৬ জন স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী এবং ৩৫ জন চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। এই চিনিকলটি বন্ধ হওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেশের অন্য চালু চিনিকলে সংযোজন করা হলেও বিপদে পড়েন দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকরা। চিনি কলে কাজ না থাকায় বিকল্প পেশায় ছুটছেন তারা। 

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ জিল বাংলা সুগার মিলস : দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা জামালপুরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান জিল বাংলা সুগার মিল। ৬৬ বছরের পুরোনো মিলটির আখ মাড়াই ক্ষমতা ১ হাজার ১৬ টন আর চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ১৫০ টন। তবে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর অনেক চেষ্টা করেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করতে পারেনি চিনি কলটি। চলতি মৌসুমে মিলটিতে আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৫ হাজার টন এবং চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৮৫০ টন। গেল বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে মিলটির আখ মাড়াই শুরু হওয়ার পর টানা ৫২ দিনে ৪৫ হাজার টন আখ মাড়াই করে ২ হাজার ৭০০ টন চিনি উৎপাদন করে মিলটি। আখের দাম বৃদ্ধির পরও পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি বন্ধ হয়ে যায় মিলের আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন কার্যক্রম। ফলে মিলটির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা এবারও অর্জন হয়নি। 

শুধু চলতি মৌসুমেই না, ২০০৯ সাল থেকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না জিল বাংলা সুগার মিলস। মিলে আখ সরবরাহকারী চাষিরা বলছেন, মিল কর্তৃপক্ষের কাছে আখ বিক্রিতে কম লাভ হয়। এ ছাড়াও আখ বিক্রির টাকা প্রাপ্তিতে সময় লাগাসহ নানা কারণে মিলে আখ সরবরাহে বিমুখ চাষিরা। ফলে বারবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে মিলটি। 

আখচাষি আবদুল মজিদ বলেন, যখন আখচাষিদের কাছে টাকা থাকে না, তখন নগদ টাকায় গাছীদের কাছে আখ বিক্রি করি। নগদ টাকায় আখ বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাই। শ্রমিকের বেতন দিই। মিল থেকে যদি সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে টাকা দিয়ে দিত, তা হলে চাষিরা আর গাছীদের কাছে আখ বিক্রি করত না। মিলেই সরবরাহ করত।

জিল বাংলা সুগার মিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রায়হানুল হক বলেন, কর্তৃপক্ষের কাছে একটাই আবেদন, এই প্রতিষ্ঠানটিকে আধুনিকায়ন করা হোক। মিলের যে মূল কাঁচা মাল আখ, সেই আখের উন্নত জাত উদ্ভাবন করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হোক। আর শুধু চিনির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আরও নানামুখী উৎপাদনের দিকে নজর দিলে মিল লাভবান হবে। 

জিল বাংলা সুগার মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান মুঠো ফোনে সময়ের আলোকে বলেন, জিল বাংলা সুগার মিলস লিমিটেড চাষিদের সঙ্গে সবসময় আছে। তাদের সঙ্গে মিল কর্তৃপক্ষের সবসময় যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আমরা চাষিদের বোঝানোর মাধ্যমে এবং মিলের পক্ষ থেকে সার, কীটনাশকসহ সব ধরনের সহযোগিতা করায় এ বছর আখের প্লান্টেশন অন্য বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। 

ঈশ্বরদীতে বন্ধ চিনিকল চালু হয়নি তিন বছরেও : পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়ায় পাবনা সুগার মিল নানা প্রতিবন্ধকতা এবং দেনার দায়ে বন্ধের ৩ বছর পার হলেও পুনরায় চালুর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এতে নষ্ট হচ্ছে মিলের মূল্যবান যন্ত্রপাতিসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। ক্রমাগত লোকসানের ভার বইতে না পেরে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর এই চিনিকলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে মাথায় হাত পড়েছে এই চিনিকলের ওপর নির্ভরশীল আখচাষিদের। পাবনা সুগার মিল বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কৃষক আখের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার কয়েক হাজার আখচাষিসহ মিলের সঙ্গে জড়িতরা। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অনেক মানুষ। সেই সঙ্গে অকেজো হতে শুরু করেছে মিলের ভারী যন্ত্রপাতিসহ শতাধিক যানবাহন। চিনিকল শ্রমিক, আখচাষি, আখচাষি ফেডারেশন ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেক অন্দোলন করলেও চিনিকলটি ফের চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মিলটি আদৌ চালু হবে কি না তা নিয়েও রয়েছে নানা সংশয়।

পাবনা সুগার মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘মাড়াই কার্যক্রম বন্ধের আগের বছর পাবনা সুগার মিলে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টন চিনি উৎপাদন করা হয়। যা বিগত কয়েক বছরে সর্বোচ্চ। এই চিনিকল চলমান থাকার সময় জেলার অনেক আখচাষি অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গিয়েছিল। লোকসান ও দেনার দায়ে ৩ বছর আগে শিল্প মন্ত্রণালয় সুগার মিলটি বন্ধ করে দেয়। এতে এ অঞ্চলের অনেক কৃষক আখ চাষ বন্ধ করে দিয়েছে। 

রংপুর চিনিকলের যন্ত্রপাতিতে মরিচা : গাইবান্ধার একমাত্র ভারী শিল্প কারখানা গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকল। লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিনিকলটির মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয়।

গত ৩ বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানা চত্বর জঙ্গলে ভরে গেছে। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে মরিচা রাজত্ব করছে। হাজারো মানুষের এক সময়ের জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ এবং মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গো-চারণভূমি। 

রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাসুমা আকতার জাহান জানান, চালু অবস্থায় এ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য বেতন-ভাতা বাবদ মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। সরকারি সিদ্ধান্তে মাড়াই বন্ধ হওয়ায় এ চিনিকলের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষায় বর্তমানে ৭ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ও ৭৫ জন অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা প্রদানে ১৮ লাখ টাকা লাগে।

সময়ের আলো/আরএস/ 






https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close