ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

নির্মাণকাজে ইটের বদলে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার
প্রকাশ: রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১:১৩ এএম  (ভিজিট : ৬১৮)
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বাতাসে বছরের বেশিরভাগ সময়ে দূষিত কণাবস্তু গ্রহণযোগ্য সীমার অধিক থাকে। ঢাকার বাতাসে দূষিত কণাবস্তু উপস্থিতির মাত্রা কখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে ২৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে গেল ২৭ জানুয়ারির ঢাকার বাতাসকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বলে অভিহিত করেছে আইকিউএয়ার। বিশ্বের ১১০টি শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে ২৭৬ স্কোরে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। সাধারণত ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে বায়ুমান স্কোর হলে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’, ১৫০ থেকে ২০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ২০১ থেতে ৩০০ হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর একিউআই স্কোর ৩০১+ হলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বছরের বেশিরভাগ সময়ে ঢাকার বাতাসের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) যা থাকে তা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’। বাংলাদেশে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের’ মতে, মানবদেহের জন্য দূষণের অসহনীয় উপাদান মাত্রা পিএম-২.৫ নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বায়ুদূষণের মাঝে বাস করছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মতে, ঢাকার বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ দায়ী নির্মাণকাজ (৩০ শতাংশ)। মানুষের প্রয়োজনে রাজধানীতে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো। আর এসব নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইট, বালু, সিমেন্ট খোলা ট্রাকে করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর এবং নির্মাণকাজ চলাকালে অসতর্কতার কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে সূক্ষ্ম বিষাক্ত কণাবস্তু। বায়ুদূষণের শতকরা রয়েছে ইটভাটা যা মোট দূষিত পদার্থের ২৯ শতাংশ। রাজধানীর অনতিদূরে আইনের পরিপন্থী ইটভাটা নির্মাণের কারণে ভাটা থেকে লোকালয়ে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসে প্রতিনিয়ত বিষ ছড়াচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণসামগ্রী হিসেবে বাংলাদেশে ইটের ব্যবহার সর্বাধিক। 

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ইট তৈরির ভাটা। এসব ইটভাটায় বছরে ২৩ বিলিয়নের বেশি ইট তৈরি হচ্ছে এবং তাতে মাটির প্রয়োজন পড়ে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ইট প্রস্তুত করতে বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন কয়লা পোড়ানো হয়। গবেষণায় বলে, বাতাসে সহনীয় বায়ুদূষকের মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম হলেও খোদ রাজধানী ঢাকায় ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়াজনিত কারণে এ-মাত্রা এখন পাঁচগুণ।

ইটভাটা নির্মাণে এবং ইট তৈরি প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনকানুন মানা হয় না। ফলে ইটভাটায় সৃষ্ট ধোঁয়ায় ঘটছে ভয়াবহ বায়ুদূষণ। দেশের বনজ সম্পদ উজাড় করার ফলে জনস্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ইটভাটার জ্বালানি দহনে ছড়াচ্ছে বিষাক্ত জীবনবিনাশী যৌগ পদার্থ। ইটভাটায় সৃষ্ট কালো ধোঁয়ায় রয়েছে মারাত্মক পরিবেশবিনাশী প্রতিক্রিয়া। ইটভাটা থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া বাতাসে মিশে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইট, সালফার ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোকার্বনসহ নানারূপ বিপজ্জনক বিষাক্ত গ্যাস। ফলে বাতাস মধ্যস্থিত অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং কার্বনের নানাবিধ যৌগের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। বেড়ে চলে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ শ^াসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি এবং ফুসফুসের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। গৃহপালিত প্রাণীর রোগবালাই বৃদ্ধি পায়। ফসলি জমির উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। 
দেশে আধুনিক পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন কয়লা দিয়ে ইটভাটা চালানোর কথা থাকলেও কোথাও কোথাও ইটভাটায় ব্যবহার করা হয় অতি নিম্নমানের কয়লা। এ ছাড়া ইটভাটাগুলোতে অতি পুরোনো কায়দায় পোড়ানো হয় বিপুল পরিমাণ কাঠ। আর এই কাঠের জোগান দিতে কেটে ফেলা হচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ-আম, তেঁতুল, সুন্দরী, মেহগিনি, শিরিষ, খেজুরসহ বিভিন্ন রকমের গাছপালা। উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে বনভূমি। ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের ফলে 

প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্রুত অবনতি ঘটছে। সরকারি বিধি-বিধান না মেনে ১২০ ফুটের কম উচ্চতায় চিমনি স্থাপনের ফলে কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন হচ্ছে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই অবৈধ ইটভাটায় জ¦ালানি হিসেবে স্থানীয় লোকালয়ের পরিবেশ রক্ষাকারী মূল্যবান কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। জনবসতি স্থানে ইট পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ায় স্থানীয় জনগণ এবং শিক্ষার্থীদের নানারূপ রোগব্যাধির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমনকি পরিবেশ দূষিত হওয়ার কারণে এলাকার রবিশস্য, আমের মুকুলসহ সব ধরনের ফল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে দেশের সর্বত্র ইটভাটায় ক্রমাগত কাঠ পোড়ানোর ফলে বিনষ্ট হয় দেশের মূল্যবান বনজ সম্পদ। হারায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য। 

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)-তে বলা হয়েছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা অর্থাৎ জিগজাগ ক্লিন, হাইব্রিড হফম্যান ক্লিস, ভার্টিক্যাল সফট ক্লিন, টানেল ক্লিন বা অনুরূপ উন্নততর কোনো প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। তা ছাড়া আবাসিক, জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকার বনভূমি ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা করা যাবে না। পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বা লাইসেন্স না নিয়ে ইটভাটা চালু করা যাবে না। এ আইন অমান্য করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান রয়েছে। ইউএনডিপির হিসাব অনুসারে দেশে ইটভাটার বেশিরভাগই পরিবেশবান্ধব নয়। ২০১০ সালে এক গণবিজ্ঞপ্তিতে সরকার ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব করার সময়সীমা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হলেও মাত্র ১০ শতাংশ ইটভাটাকে পরিবেশবান্ধব করার হিসাব পাওয়া যায়। বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে কম গতিবেগে বায়ুপ্রবাহে ইটভাটাগুলো পুরোদমে চালু থাকলে সহজে পরিবেশ দূষক বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করে জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে। ২০১৯ সালে পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্ট-বালুর তৈরি ব্লক ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) বিল-২০১৩ বিল সংসদে উপস্থাপন করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। পরে মন্ত্রণালয় থেকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)-এর ধারা ৫(৩ক)-এর প্রজ্ঞাপন বলে মাটির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানোর উদ্দেশ্যে সব সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ভবনের দেয়াল ও সীমানাপ্রাচীর, রাস্তা ও গ্রাম সড়ক টাইপ-বির ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কাঠ পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে ইটভাটার স্থান নির্বাচন, ভাটা নির্মাণ প্রক্রিয়া, বিশেষ করে চিমনির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। ইটভাটা লোকালয় থেকে দূরে স্থাপন করে চিমনিকে সর্বনিম্ন ১২০ ফুট উচ্চতায় রাখতে হবে। বিশেষ করে, ইটভাটায় কাঠের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। অবকাঠামো নির্মাণকাজে অতি প্রয়োজনীয় ইটের ব্যবহারকে মাথায় রেখে দেশের ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করে তোলা বিশেষ জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের কঠোর নজরদারি অত্যাবশ্যক।

উন্নত বিশ্বে নানা ধরনের ব্রিক ক্লিনে আধুনিক প্রক্রিয়ায় ইট পোড়ানো হয়ে থাকে। এ সবের মধ্যে অধিক প্রচলিত হচ্ছে-এফসিকে পদ্ধতি, যাতে জ্বালানির জন্য কয়লা ও কাঠ উভয়ই ব্যবহার করা যায়। আইএফসিকে পদ্ধতিতে ইট পোড়ানো হলে জ্বালানির দহনে কোলো ধাঁয়ার নির্গমন কম হয়। প্রায় ৬০ বছর আগে চীনে প্রচলিত ভিএসবিকে পদ্ধতিতে ইট পোড়ানো হলে জ্বালানির অন্তর্দহনে যেমন কম দূষিত কালোধোঁয়া নির্গত হয়, তেমনি ব্রিক ক্লিনটি সারা বছর চালু রাখা যায়। কিন্তু তাতে অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় কম ইট তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে ইট পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে কাঠের পরিবর্তে উন্নত মানের কয়লা ব্যবহার করতে পারলে দেশের বনজ সম্পদ যে রক্ষা পাবে। ইটভাটা ধোঁয়া থেকে বায়ুদূষণ রোধে সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্য্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী দিনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মাটির তৈরি ইট বাদ দিয়ে নির্মাণ উপকরণ হিসেবে সিমেন্ট-বালুর তৈরি ইট বা ফাঁপা ব্লক ব্যবহারের ব্যাপারে এখনই প্রযুক্তিবিদদের চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close