রাখাইনের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) মঙ্গলবার আরও একটি সামরিক ব্যাটলিয়ন ঘাঁটি দখলে নেওয়ার দাবি করেছে। রাখাইনে তাদের ক্রমবর্ধমান আক্রমণের ধারাবাহিকতায় এবার লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন (এলআইবি) ৫৪০ দখলে নেওয়ার কথা জানিয়েছে তারা। আরাকান আর্মি বলেছে, ম্রাউক-ইউ অঞ্চলে কয়েক দিন ব্যাপক লড়াইয়ের পর এই ঘাঁটি দখলে সমর্থ হয় তারা। একইসঙ্গে এলআইবি ৩৭৭ ও ৭৭৮ও ঘিরে ফেলেছে তারা। মিয়ানমার বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইরাবতির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এবার আরাকান আর্মির নজর রাখাইন রাজ্যের রাজধানীতে। এদিকে সামরিক অভ্যুত্থানের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যও নতুন করে নেপিডোকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে, তবে তারা এক্ষুণি ভেঙে পড়বে কিনা, তা নিশ্চিত নয়।
আরাকান আর্মির লক্ষ্য রাজধানী সিত্তে : ইরাবতির খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনারা রাখাইনের প্রাচীন রাজধানী শহরে অবস্থিত ম্রাউক-ইউ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, ঐতিহাসিক মঠ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গোলাবর্ষণ করছে। আরাকান আর্মির একটি বাহিনী মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাত ১১.৪৫ মিনিটে এলআইবি ৫৪০ সদর দফতরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়। এবার তারা অবশিষ্ট দুটি সামরিক ঘাঁটি এবং অন্যান্য জান্তা ফাঁড়িকে লক্ষ্যবস্তু করছে।
আরাকান আর্মি ব্রাদারহুড জোটের সদস্য। ওই জোটের মধ্যে আরও রয়েছে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং তা-আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। গত বছরের ২৭ অক্টোবর অপারেশন ১০২৭ শুরু করার পর থেকে জাতিগত এই জোট উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ দখল করেছে যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ২০টি শহর এবং চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ।
জান্তার সঙ্গে চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার পর জোটটি জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে তাদের আক্রমণ বন্ধ করে দেয়। যাহোক, আরাকান আর্মি অপারেশন ১০২৭-এর অংশ হিসেবে, ১৩ নভেম্বর থেকে প্রতিবেশী চিন রাজ্যের উত্তর রাখাইন এবং পালেতোয়াজুড়ে একটি বিস্তৃত আকারের আক্রমণ পরিচালনা করছে। এটি পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং শক্তিশালী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) সঙ্গেও জোট করেছে।
জাতিগত জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বুধবার রাখাইনের উপকূলীয় রামরিতে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। আরাকান আর্মির সেনারা বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করেছে। শহরজুড়ে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাদের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছে তারা। ভূমিতে পরাজয়ের পর বুধবার জান্তার বিমান ও গানবোট আবারও রামরি শহরে গুলি চালায়। রামরি কিয়াউকফিউর সীমানা, একটি চীন-সমর্থিত গভীর সমুদ্রবন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বুধবার সকালে রাজ্যের রাজধানী সিত্তের কাছাকাছি উপকূলে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।
ইরাবতি জানিয়েছে, জান্তা সৈন্যরা যুদ্ধস্থল থেকে পিছু হটেছে। আরাকান আর্মির লক্ষ্য এখন রাজধানী সিত্তের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। জাতিগত জোট বলেছে, সিত্তেতে অবস্থিত সামরিক গানবোট এবং পুলিশ একযোগে প্রায় ১০০ বার গোলাবর্ষণ করেছে। বুধবারও রাখাইনের মিনবিয়া, কিউকতাও এবং রাথেদাউং শহরে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে সিত্তের কাছের পাউকতাসহ ১৬০ সেনা অবস্থানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছে আরাকান আর্মি।
যুক্তরাষ্ট্রের পর এবার যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা : মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ৩ বছর পূর্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পর বৃহস্পতিবার নতুন করে সামরিক কয়েকটি ইউনিট এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাজ্যও। এসব সেনা ইউনিট এবং প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে ‘নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন’ এবং ‘মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত’ বলে অভিযোগ করেছে যুক্তরাজ্য।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, সামরিক কয়েকটি ডিভিশন এবং মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী সঙ্গে জড়িত দুটো রাষ্ট্র-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের হিসাব মতে, ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে ৩ বছরে দেশটির মোট ২৫ ব্যক্তি এবং ৩৩টি প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞা-কবলিত হলো।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের ৩ বছর পর আমরা দেশটির জনগণের ওপর সামরিক বাহিনীর নৃশংস নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য চাপ বাড়াচ্ছি।’ পররাষ্ট্র দফতর আরও বলেছে, তারা ইইউ এবং আরও ৮টি দেশের সঙ্গে মিলে একটি যৌথ বিবৃতিও প্রকাশ করেছে। এতে নিজ দেশের নাগরিকদের ধারাবাহিকভাবে নিপীড়ন এবং সহিংসতা চালিয়ে আসার জন্য মিয়ানমারের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর নিন্দা জানানো হয়েছে।
চরম হুমকির মুখে জান্তা : ব্যাংককভিত্তিক বিশ্লেষক ডেভিড স্কট ম্যাথিসন বিবিসিকে বলেছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার হুমকির মুখে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের মুখে তারা সহসা ভেঙে পড়বে কী না, সেটি এখন বলা কঠিন বলে তিনি মনে করেন। ম্যাথিসন বলেন, সংঘাত যেভাবে চলছে এবং সেনাবাহিনীর যে শক্তি আছে তাতে মনে হচ্ছে এটার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে এবং দীর্ঘমেয়াদে সেনাবাহিনীর পরাজয় হতেও পারে। তবে সেটা কত দিন লাগবে কিংবা সেটা কীভাবে হবে তা বলা কঠিন।
এদিকে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে নজিরবিহীন বলে বর্ণনা করছেন ব্রাসেলাস-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টম কিন। তিনি বিবিসিকে বলেন, সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মিয়ানমার জান্তা সরকার ভেঙে পড়ার হুমকিতে আছে। এই সংঘাত মূলত রাখাইনে ও শান প্রদেশে সীমান্তবর্তী এলাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। দেশের ভেতরের দিকে এখনও ছড়ায়নি।
সময়ের আলো/আরএস/