ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পিঠা
প্রকাশ: শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১:৪৩ এএম  (ভিজিট : ১১১২)
আমরা ছোটবেলায় চমৎকার একটি লেখা পড়েছি। ‘এক ছিল টোনা আর এক ছিল টুনি। টোনা বলে ওরে টুনি পিঠা কর। টুনি টোনাকে বলে চাল আনো ডাল আনো তবে তো পিঠা... ’ কিংবা ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/ আরো উল্লাস বাড়িয়েছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় কবি সুফিয়া কামাল এভাবেই পিঠাকে এঁকেছেন। আর সাহিত্যে এভাবেই স্থান করে রেখেছে রসের খাদ্য পিঠা। 

বাঙালির খাদ্য আয়োজনে পিঠা একটি অবিচ্ছেদ্য উপকরণ। বাঙালিকে চিনতে হলে বাংলার খাদ্য
সংস্কৃতিকে জানতে হবে। খাদ্যরসিক বাঙালির পাতে পৌষের টনটনে শীতে পিঠা থাকবে না! এ যেন কল্পনাও করা যায় না। এমনকি বাঙালির ঐতিহ্য বহন করা সাহিত্যেও পিঠার কথা রসের মতোই রসিয়ে রসিয়ে বর্ণিত হয়েছে। বাংলা ভাষার ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য ময়মনসিংহ গীতিকা, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, রামায়ণ কৃত্তিবাসীতে বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তা দেখা যায়।
 
ময়মনসিংহ গীতিকায় কাজল রেখার পিঠা তৈরির বিবরণ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন- ‘নানান জাতের পিঠা করে গন্ধে আমোদিত/ চন্দ্রপুলি করে কন্যাচন্দ্রের আকিরত/  চই চপরি পোয়া সুরস রসালো/ তা দিয়া সাজাইল সুবর্ণের থাল/  ক্ষীরপুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া/ রসালো করিল তায় চিনির ভাঁজ দিয়া।’ আবার ঈশ^রচন্দ্র গুপ্তের কবিতা পৌষ পার্বণে তিনি পিঠাকে রাঙিয়েছেন যেভাবে। ‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর/ গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার/ বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা/ হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।’ কবিতায় তিনি চমৎকারভাবে বাঙালির আতিথেয়তা এবং আত্মীয়তার বন্ধনকে পিঠার আমেজে কলমে তুলে এনেছেন। 

পিঠার মূল উপাদান চাল এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপাদান যা বছরের যে কোনো সময় সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু শীতকালে নতুন চাল পিষে পিঠার আয়োজন, বাঙালি সংস্কৃতিকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। পিঠাকে বাঙালি এতটাই উৎসবমুখর করেছে যে বাংলার বেশকিছু অঞ্চলে বিয়ের পর কন্যা প্রথমবার পোয়াতি হলে সপ্তম মাসে ‘সাতোশ’ নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটি সাধারণত পুরি পাকন পিঠা বা চন্দ্রপুলি পিঠা দিয়ে সাজানো হয়। 

অঞ্চলভেদে পিঠার বিভিন্ন প্রকারভেদ থাকলেও বেশকিছু পিঠা বাংলার সকল অঞ্চলে এবং সমাজে বেশ সমাদৃত। যেমন ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, দুধ চিতই, ছিটা পিঠা, পাটিসাপটা ইত্যাদি। 

ঢাকার কিছু অঞ্চলে বাঙালি সংস্কৃতির সবচাইতে মজার বিষয় হলো, জামাইকে শশুরবাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে জামাইবাড়িতে উপহার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের পিঠা পাঠানো হয়। অর্থাৎ বাড়িতে নতুন ধান উঠেছে। জামাই মেয়েকে নিয়ে এসে উৎসবে শরিক হও। এ নিয়ে চমৎকার শ্লোকও রয়েছে। যেমন- ‘ভাদর মাসে ভাদই ধানের পুয়া কত মিঠ্যা/ ভ্যাসকা গুড় ভালো নয়, গুড় ভালো চিট্যা। (খ্যামটা/ নবাবগঞ্জ) 

আবারও সাহিত্যের কাছে ফিরে যাই পিঠা নিয়ে বরিশালের বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলেও ছন্দ এবং তালের পিঠার বর্ণনা রয়েছে। যেমন- ‘মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস/ দুই তিন প্রকারের পিষ্টক (পিঠা) পায়েস/ দুগ্ধে পিঠা ভালোমতো রান্ধে ততক্ষণ/ রন্ধন করিয়া হৈল হরসিত মন’। বর্তমান শহরে আধুনিক বিয়েতেও দেখা যায়, বিয়ের মূল ভোজন পর্ব শুরুর আগেই অভ্যাগত অতিথিকে পিঠাপুলি দিয়েই স্বাগত জানানো হয়। 
চলচ্চিত্রেও পিঠার আয়োজন খুব ধুমধামে দেখানো হয়। বিখ্যাত বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের লেখা ছোটগল্প ‘অতিথি’ যার চলচ্চিত্র রূপ ‘আগন্তুক’। ছবিতে তিনি ছোট  মামার আগমনের আয়োজনকে বর্ণিল করে তুলেছেন তাকে স্বাগত জানাতে পিঠার প্রস্তুতির আয়োজনে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যায়, বাঙালির দৈনন্দিন জীবন, তার শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি এবং চলচ্চিত্রে পিঠা এক অবিচ্ছেদ্য রসালো অঙ্গ। 

শেষ করব বর্তমান সময়ের কাব্য কবির নামে এক কবির রচনা দিয়ে। ‘শীত এলেই গাঁয়ের বাড়ি/ পিঠা তৈরির মেলা/ গাঁয়ের বধূ পিঠা বানায়/ কাটিয়ে দেয় বেলা।/ ছানা পুলি, নারকেল পুলি/ পাটিসাপটার ঘ্রাণ/ ভাপা, সেমাই, পাকন পিঠা/ নেচে ওঠে প্রাণ/ খেজুর রসে ভেজানো হয়/ চিতই নামের পিঠা/ ভেজানোর পর খেলেই তা/ লাগে যেন মিঠা।/ শীতের পিঠা খাই সকলে/ একটু আয়েশ করে/ শীতের পিঠা দেখলে আবার/ মনটা ওঠে ভরে।’

সময়ের আলো/আরএস/







https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close