ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

কবি জাহিদুল হক
অমৃত জগতের বাসিন্দা
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪, ৩:১৭ এএম  (ভিজিট : ৫৩৬)
দূর থেকে ভেসে আসা মধুর বাঁশির সুর শুনে ‘পকেটভর্তি মেঘ’ নিয়ে চলে গেলেন জাহিদুল হক। জাহিদুল হকের নামের আগে অনেক বিশেষণ প্রযুক্ত করা গেলেও তিনি মূলত এবং প্রধানত ছিলেন কবি। ষাটের দশকে আবির্ভূত এই কবি শিল্পের সঙ্গেই বসবাস করে গেছে আমৃত্যু। তাই তো তাকে আমরা গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং গীতিকার পরিচয়েও পাই। শেখ সাদীর সুরে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে বাংলার ঘরে ঘরে তিনি পৌঁছে গেছেন এবং যাবেন অনাগত কালেও। 

জাহিদুল হক ১৯৪৯ সালে ১১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি রেডিওতে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত না নেওয়ায়, তারা কয়েকজন রেডিও বন্ধ করে দেন। জাহিদুল হক এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনা ব্যক্ত করেছেন, ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ শাহবাগ কেন্দ্রের অফিসার ইনচার্জ ছিলাম। এটা তখন বিশাল বিষয়। অনেক ক্ষমতাধর। আমরা পরিকল্পনা করলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করব। সব প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে করাচি থেকে বার্তা এলো ভাষণ প্রচার করা যাবে না। তাদের ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা করে দেন! আমার তো মাথায় আগুন। এমনিতেই বাম রাজনীতি করে আসা ছেলে আমি। সবাই আমাকে মানতো। ভাষণ প্রচারে বাধা আসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দেব। আমি আর আশফাকুর রহমান খান, আমার সিনিয়র। চমৎকার মানুষ ছিলেন। তাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, চলো রেডিও বন্ধ করে দিই। সবাই তখনই মাস্টার কন্ট্রোল রুমে (এমসিআর) গেলাম। সন্ধ্যা ছয়টা-সাড়ে ছয়টা হবে। সেখানে গিয়ে একে অপরের হাতে হাত রেখে স্টেশন সুইচ অফ করে দিলাম।

বঙ্গবন্ধু নিজেই তো সেদিন বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি...’। সেই মন্ত্রবলেই বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এই কাজের মাধ্যমে আমিই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। এর আগে তো যুদ্ধটা শুরু হয়নি। এই গৌরব আমি করতেই চাই। এটা আমার আত্মজীবনীতেও লিখব। আমিসহ সেদিন আরও যারা সহকর্মী ছিলেন, সবাই মিলেই মুক্তির যুদ্ধটা শুরু করেছি বেতার থেকে। পরদিন অবশ্য, সচিব-মন্ত্রী-সামরিক বাহিনী পর্যন্ত গড়ালো বিষয়টি। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতার সম্প্রচার করবে। আমাদের আশ^স্ত করল। আমরা পরদিন আবারও কাজে ফিরলাম।’

জাহিদুল হক আমৃত্যু কবিতার সঙ্গে ঘরকন্না করতে চেয়েছেন। তাই তার লেখা গান এত জন্মপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি খুব বেশি গান লেখেননি। শতাধিক গানের গীতিকার হিসেবেই নিজের পরিচয়কে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। অথচ তিনি চাইলে জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে গানের সংখ্যা হাজারে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। 

জাহিদুল হকের কবিতা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তার কবিতায় কল্পনা চড়ারঙে মাখা। তিনি খুব সামান্য বিষয় নিয়েও কল্পনার জাল বুনতে পারতেন। কবিতায় রূপ দিতে জানতেন। দীর্ঘ কবিতাময় জীবন যাপন করার পরেও আমরা তার কবিতায় পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই না। নিজেকে তিনি বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন। একই কেন্দ্রের কক্ষপথে বারবার আবর্তিত হতে চাননি। তাই ষাটের দশকের অনেক কবির তুলনায় তিনি নির্জন-নিমগ্ন হলেও তার কবিতা অত্যুজ্জ্বল। জাহিদুল হক ছিলেন আন্তর্জাতিক মননের অধিকারী। তার কবিতায় আমরা দেখতে পাই আন্তর্জাতিক চেতনার বিস্তার। এক্ষেত্রে আমাদের মনে পড়ে তিরিশের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তীর কথা। অমিয় চক্রবর্তীর মতো আমরা জাহিদুল হকের কবিতাতেও দেখি প্রচুর বিদেশি শব্দ। তিনি নৈপুণ্যের সঙ্গে কবিতায় বিভাষী শব্দ, অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। বইয়ের নামকরণের ক্ষেত্রেও তার এই প্রীতি আমাদের চোখে ধরা পড়ে। যেমন- ‘এই ট্রেনটির নাম গার্সিয়া লোরকা, নেভাল কোথায় যাচ্ছ, মিকেলাঞ্জেলাগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা প্রভৃতি। 

সৌমিত্র শেখর জাহিদুল হকের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘ধীরের চেয়ে দোদুল লয়ের প্রতি জাহিদের আগ্রহ বেশি; মিথ ও দর্শনস্পর্শী অনুষঙ্গের প্রতি দুর্বলতা অধিক। ধীর লয়ের বাইরেও যে আধুনিক চমৎকার কবিতা সৃজিত হতে পারে, জাহিদ সেটা দেখিয়েছেন।’

জাহিদুল হকের কবিতার ভাষা ঋজু, সাবলীল। স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। ছিলেন ছন্দসচেতন। বিষয় নয়, কবিতাকে কবিতা করে তোলার দিকেই ছিল তার প্রবণতা। 

বিশ্ব-শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তিনি বরাবরই ছিলেন মনোযোগী। টেলিভিশনে তিনি চির শিল্পের বাড়ি নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সেই অনুষ্ঠানটি করেছেন। সেখানে বিশ^-শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দারুণ মনোজ্ঞ আলোচনা হতো।  জাহিদুল হকের বইয়ের সংখ্যা প্রায় বিশটি। ৭৫ বছরের এক বর্ণময় জীবন তিনি কাটিয়েছেন। তারপরেও তার চলে যাওয়াকে আমরা অকালেই চলে যাওয়া বলব। তবে কবির তো মৃত্যু নেই। কবি অজস্র মৃত্যুকে পেরিয়ে চলে যান অমৃতের জগতে। কবি জাহিদুল হকও সেই অমৃত জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। মৃত্যুকে পার হয়ে গেলেন হাজার মৃত্যু ছাড়িয়ে- যে কথা একদিন তিনি বলেছিলেন, 
‘জীবনে কতো কিছু লিখতে পারি আমি সহজে
কেবল সেই মুখ তুলিতে দিতে পারি না;
তা হ’লে এসো আজ দু’জনে ভালোবাসি দু’জনে,
মৃত্যু পার হবো হাজার মৃত্যুকে ছাড়িয়ে।’

সময়ের আলো/আরএস/ 







https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close