সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রেন প্রথম স্টেশন ছেড়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। গতকাল ছিল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ ২৬টি দলের প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। যদিও গত ১৫ নভেম্বর ইসির তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা হিসাব-নিকাশ চলছিল। নির্বাচনি ট্রেনে বিএনপিসহ কোন কোন রাজনৈতিক দল উঠবে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে আদৌ নির্বাচন হবে কি হবে না, এমন নানা প্রশ্ন ছিল রাজনৈতিক মহলে। সব প্রশ্নের জবাব মিলেছে গতকাল। গতকাল ভোটের ট্রেন প্রথম স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে। ফলে ইসির দেওয়া তফসিল অনুযায়ী, যেসব রাজনৈতিক দল মনোনীত প্রার্থীরা গতকাল পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করেনি ওই রাজনৈতিক দলগুলোর আর ভোটে অংশগ্রহণের সুযোগ রইল না। এ যাত্রায় আবারও ২০১৪ সালের মতো নির্বাচনি ট্রেন মিস করল বিএনপি।
গতকাল নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানান, আজ (গতকাল) বিকাল ৪টায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশন মনে করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিলের সময়সীমা বর্ধিতকরণের আর কোনো সুযোগ নেই। প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। আমরা ১ ডিসেম্বর কয়টি দল কোন আসনে, মোট কতজন প্রার্থী দিয়েছে তা জানাতে পারব। যেসব দল মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি, তাদের জন্য সময়সীমা বর্ধিতকরণের আর কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপি ছাড়াই কি নির্বাচন হচ্ছে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আপনারা বুঝে নেন। গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তফসিল অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র যাচাই করবেন আজ শুক্রবার থেকে আগামী ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ও নিষ্পত্তি করা হবে ৫ থেকে ১৫ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ এবং আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর। প্রচার চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। আর নির্বাচন ৭ জানুয়ারি।
এরই প্রেক্ষিতে গত ১৮ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা নেওয়া হয়। এই সময়ে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা পড়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। ফরম বিক্রি করে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা আয় করেছে দলটি। পরে গত ২৩ থেকে ২৫ নভেম্বর তিন ধাপে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বাছাইয়ে দলীয় মনোনয়ন বোর্ড বৈঠক করে। এতে সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি ও মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা।
পরের দিন ২৬ নভেম্বর ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দুটি আসন ফাঁকা রেখে ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেন। এরই প্রেক্ষিতে দলীয় প্রার্থীরা গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেন।
তবে বিএনিপসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনে না আসার পক্ষে অনড় থাকায়, গতকাল যেহেতু মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন ছিল, ফলে নির্বাচনি ট্রেন থেকে সিটকে পড়ল তারা।
সঙ্গত কারণে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে যে পরিকল্পনা করেছিল, সেটি বাস্তবায়নে ভোটের ট্রেন প্রথম স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে গতকাল। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ যে ২৬টি দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তারাই এখন নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৃহস্পতিবার ছিল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। দেশের নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ ২৬টি দলের প্রার্থীরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) যেহেতু বলে দিয়েছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াসহ তফসিল পুনর্নির্ধারণের আর সুযোগ নেই, এতে বোঝাই যাচ্ছে নির্বাচনের ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, জনগণের অংশগ্রহণে একটি ভালো নির্বাচন হবে। আগামী নির্বাচন ভোটারবিহীন হবে না। জাতিসংঘ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠালেও যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথসহ অনেকে পাঠাচ্ছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে প্রায় শতাধিক পর্যবেক্ষকের নাম এসেছে। নির্বাচনের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা বলেছে, আমরাও তা-ই চাই। নির্বাচন নিয়ে যত বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, যত অপবাদ ছাড়ানো হয়েছে, সেখানে কিন্তু অনেকে ভেবেছিল বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সাড়া দেবেন না। কিন্তু ইতিমধ্যে শতাধিক পর্যবেক্ষক সাড়া দিয়েছেন। এ নিয়ে আমরা চিন্তিত না।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, নির্বাচনের ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, সেটি থামানোর ক্ষমতা আন্দোলনে থাকা বিএনপির নেই। অবরোধ-হরতাল এখন ভয়তাল হয়ে গেছে। যে ট্রেন ছেড়ে গেল, সে ট্রেন থামানোর ক্ষমতা তাদের নেই। তবে ট্রেনে তারা না উঠলে আমরা কী করব? নির্বাচনি ট্রেন কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। ট্রেন ছাড়লে তো আর থামে না। থেমে থাকবে না। নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে, আমাদের এর বিকল্প কী করার আছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করলেও সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া দেওয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। এর মধ্যে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি। ইসিও বলছে, তফসিলের সময় আর বাড়াবে না। ফলে নির্বাচনি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এতে এবারও নির্বাচনি ট্রেন মিস করল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, যেহেতু বিএনপি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি, সে হিসেবে তাদের ছাড়াই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন চাইলে তফসিল পেছাতে পারত। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে আসার ব্যাপারে কিছু বলেনি, তাই হয়তো নির্বাচন কমিশনও তফসিল পুনর্নির্ধারণ করবে না। যেহেতু আর তফসিল পুনর্নির্ধারণ হচ্ছে না, ফলে নির্বাচনি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সময়ের আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। যেহেতু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। পুনঃতফসিলও হচ্ছে না, ফলে নির্বাচনি ট্রেন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই ট্রেন মিস করেছে বিএনপি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল। আর পুনঃতফসিলও হচ্ছে না। এতে নির্বাচনি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বিএনপির আর নির্বাচনি ট্রেনে ওঠার সুযোগ থাকল না। ফলে বিএনপিকে বাইরে রেখেই আরেকটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান সময়ের আলোকে বলেন, ভালো একটি নির্বাচন মানে-সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন।
একতরফা নির্বাচন হলে সেটা রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হয় না। ফলে আমাদের একটা ভালো নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। ইসিও বলছে, তফসিল পুনর্নির্ধারণ করা হবে না। ফলে বলতেই হয়, নির্বাচনি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্ধারিত সময়ে মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি। ফলে এবারও বিএনপি নির্বাচনি ট্রেন মিস করল।
সময়ের আলো/জেডআই