নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অবস্থানে অটল থাকলেও বিএনপির বিভিন্ন সারির অনেক নেতা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে বিএনপি ছেড়ে তারা অন্য দলে যোগ দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে ক্ষোভ-অভিমানে থাকা বর্তমান নেতা, বিগত দিনের নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত ও সাবেক সংসদ সদস্যসহ পরিচিত মুখ রয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রাগ-ক্ষোভ-অভিমানে দল থেকে দূরে সরে যাওয়া নেতারাও। দুয়েক দিনের মধ্যে এ তালিকা আরও বড় হতে যাচ্ছে।
বিএনপি বলছে, সরকার নির্বাচনের আগে দলে ভাঙন ধরাতে মরিয়া। দলটির নেতাদের একটা অংশকে বের করে এনে ভোটে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা করছে। প্রলোভন, টোপ আর চাপ দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাকেই বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। যারা দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা মানবেন না; শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় দুজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মধ্যম সারির কিছু নেতা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে বিএনপি। নির্বাচনে না গেলে স্বাভাবিকভাবে দলে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হতে পারে।
সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ ঘটা দল ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম’-এ যোগ দিতে যাচ্ছেন বিএনপির জেলা পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিতে পারেন। দলটির আহ্বায়ক ও বিএনপির সাবেক নেতা ভিপি নাজিম উদ্দিন সময়ের আলোকে জানান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমদ ও ফেনী জেলা নির্বাহী কমটির সদস্য জুলফিকার আলী, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আরিফ মঈনউদ্দিনসহ আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আজ তাদের দলে যোগ দিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন নাজিম উদ্দিন। সবশেষ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকারকে আহ্বায়ক করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির কমিটি হয়। এতে স্থান হয়নি তার। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হলে সে সময় তিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন। জানা গেছে, এই দলটি তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নেবে।
বিএনপির আলোচিত ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদও দুয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। যদিও হাফিজ বিষয়টি এখনও ধোঁয়াশায় রেখেছেন। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপির ওপর রাগ, ক্ষোভ ঝাড়েন। বিএনপির নেতৃত্ব নিয়েও কিছু উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি। একইসঙ্গে বিএনপিকে বিদেশিদের মধ্যস্থতায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত বলেও মতপ্রকাশ করেন। বিএনএমের নেতারা আশা করছেন, মেজর হাফিজ দুয়েক দিনের মধ্যেই দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবেন। সামনে আরও চমক আছে। নিবন্ধিত এ দলে সোমবার যোগ দেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর, মো. আবদুল ওহাব, দেওয়ান শামসুল আবেদিন ও অধ্যাপক আবদুর রহমান। আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। তাদের বেশিরভাগের অভিযোগ, তারা বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে অবমূল্যায়িত। দলের সাংঘর্ষিক নীতি ও আদর্শের সঙ্গে মেলাতে পারছিলেন না। বিএনপির ভেতর ত্যাগী ও মূলধারার নেতারা বরাবরই বঞ্চিত হচ্ছেন।
কয়েক দিন আগে বিএনপির নির্বাহী কমিটির দুই সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব ও একেএম ফখরুল ইসলাম নতুন জোট করে ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নিবন্ধন না থাকায় তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন। এমন ঘোষণার পরপরই তাদের দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। নতুন এ জোটে বিএনপির বর্তমান ও সাবেক ১২৫ জন নেতা রয়েছেন বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। আহসান হাবিব সময়ের আলোকে জানান, কয়েক দিনের মধ্যে বিএনপির ৫-৭ জন পরিচিত নেতা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেবেন।
এদিকে আলোচিত দল তৃণমূল বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম কিনছেন বিএনপির জেলা পর্যায়ের অনেক বর্তমান ও সাবেক নেতা। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গড়া এ দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরী ও মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের বহিষ্কৃত উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার। সময়ের আলোকে তৈমূর আলম বলেন, বিএনপি বড় দল। আগে আমি বিএনপি করেছি। তাদের নিয়ে তির্যক মন্তব্য করতে চাই না। তবে তাদের দোষের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা অন্য দলে যোগ দেবেন। সময় হলেই তা দেখা যাবে।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, সরকার ভয়ভীতি, প্রলোভন দেখিয়ে ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও ‘বিএনএম’র ব্যানারে নির্বাচন করতে নানা ফন্দি-ফিকির করছে। ইতিমধ্যে তাদের কয়েকটি আসন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তাদের বিরোধী দল বানিয়ে সংসদকে লোক দেখানো কার্যকর করতে চায়। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান সময়ের আলোকে বলেন, গত দেড় দশকে বিএনপি ভাঙার চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। এবারও অপপ্রচার-অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার মরিয়া হয়ে গেছে, কীভাবে একটা ভুয়া, সাজানো, একতরফা নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে জাহির করা যায়।
সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেন, বিএনপি না এলেও অনেক সিনিয়র নেতা নির্বাচনে অংশ নেবেন। বিএনপি তাদের ঠেকাতে পারবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার সময়ের আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব নাম এসেছে তাদের চলে যাওয়ায় বিএনপি বিব্রত, তবে বিপর্যস্ত নয়। তবে সামনের সারির কেউ চলে গেলে বড় শঙ্কার মুখে পড়তে হবে দলকে।
সময়ের আলো/জেডআই