ভোজ্য তেলসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা গত বছরের তুলনায় এ বছর বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ভোজ্য তেলের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার টন। এ বছরের জানুয়ারিতে ৩৮ হাজার টন বেড়ে সেটি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৩ মেট্রিকটনে। আবার গত নভেম্বর-জানুয়ারি, এই তিন মাস সময়ে পাম অয়েল আমদানি ৪২ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৪ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।
জানুয়ারি মাসে ৫ লাখ ৬৬ হাজার টন চিনি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ৫৫ হাজার টন বেশি। আবার জানুয়ারিতে খেজুর আমদানির ঋণপত্র ১৩ হাজার টন বেড়ে ২৯ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। ছোলার আমদানি কমলেও মসুর ডালের আমদানি বেড়েছে।
এ তথ্যগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং তথ্যগুলো চিত্রই বলছে রোজাকে সামনে রেখে দেশে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ও মজুদ কিন্তু ভালোই হয়েছে। ডলার সংকট ও এলসি খোলার জটিলতা নিয়ে ব্যবসায়ীরা অনেক আহাজারি করলেও তলে তলে ঠিকই পণ্য আমদানি করেছেন এবং রোজার পণ্যের বেশ ভালো মজুদ গড়ে তুলেছেন। যদিও বাজারে দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং সংকটের কথা বলে সরবরাহ কমিয়ে পণ্যমূল্য বাড়িয়েই চলেছেন ব্যবসায়ীরা। রোজার আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের আমদানি ও মজুদ চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এগুলোর আমদানি ও এলসি খোলা কিছু কম হলেও যেগুলো আসছে তার পরিমাণও কিন্তু কম নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি তিন মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টন, যা এক বছর আগের একই মাসগুলোর তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম। সয়াবিন বীজ আমদানি কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ টনে। বিগত তিন মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৮২ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ হাজার টন কম। বিগত তিন মাসে ছোলা আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। মটর ডালের আমদানি কমেছে ১৮ শতাংশ। তবে জানুয়ারি মাসে এসব পণ্যের এলসি খোলা বেড়েছে। আর জানুয়ারি মাসের এলসির পণ্যগুলো চলে আসবে রোজার আগে বা রোজার শুরুতেই। সুতরাং রোজার এসব গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের আমদানি ও মজুদও মন্দ নয়।
পণ্যের আমদানি ও এলসি খোলার চিত্র যদি এ রকম হয়েই থাকে- তাহলে ব্যবসায়ীরা কেন এত হা-হুতাশ করছেন এবং বলছেন, ডলারের কারণে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না- তাই দাম কমছে না এবং রোজার আগে দাম আরও বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের এসব কথাকে চাতুরতা এবং এক রকম ধোঁকাবাজি বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে বেপরোয়া হয়ে গেছেন। এ জন্য তারা ভেতরে ভেতরে পণ্য আমদানি করলেও ওপরে ওপরে বলছেন- পণ্য আমদানি কম হচ্ছে, ডলার নেই, এলসি খোলা যাচ্ছে না। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন রকমের ভোগ্যপণ খালাস হচ্ছে এবং সেগুলো চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের গুদামে। ডলার ও এলসি সংকটের কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছিল বলেই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে অন্যান্য পণ্যের এলসি কম খুলে ভোগ্যপণ্যের এলসি খুলতে এবং ধারে পণ্য আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে। এসব কারণে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলাও বেড়েছে এবং আমদানিও বেড়েছে। তারপরও ব্যবসায়ীরা কিন্তু ঠিক বলছেন পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। আসলে কথাটি ঠিক না, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত তিন-চার মাসে ভোগ্যপণ্যের আমদানির জন্য প্রচুর এলসি খোলা হয়েছে, দেশেও সেসব পণ্যের বেশিরভাগ চলে এসেছে- রোজার আগে বাকিগুলোও চলে আসবে। সুতরাং এবারের রোজায় প্রকৃত অর্থে কোনো পণ্যের ঘাটতি হওয়ার কথা না। ব্যবসায়ীরা যদি অসততার সঙ্গে ব্যবসা করে মানুষের পকেট খালি করতে চায় তাহলে তারা কৃত্রিম সংকট করে পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়াবে।
তিনি আরও বলেন, সরকারকে এখানেই শক্ত ভ‚মিকা নিতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠান কোন পণ্য কী পরিমাণে আমদানি করেছে, কোথায় মজুদ করে রেখেছে এবং সেগুলো বাজারে ঠিকমতো ছাড়ছে কি না- এসব বিষয় কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। দরকার হলে ভোক্তা অধিদফতরের পাশাপাশি সব গোয়েন্দা সংস্থাকে আগামী দেড়-দুই মাসের জন্য ভোগ্যপণ্যের বাজারে কড়া নজরদারিতে নামাতে পারে সরকার। তাহলে ব্যবসায়ীরা অতটা বেপরোয়া হতে পারবে না, রোজায় দেশের মানুষ ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারবে। আমরা প্রত্যাশা করব সরকার সে ধরনের ভ‚মিকা নেবে।
রোজার ভোগ্যপণ্যের আমদানি যে বেশ ভালো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকও সেটি জানিয়েছেন। গত ২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না-ব্যবসায়ীদের এ তথ্যও তিনি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘রমজান মাস সংশ্লিষ্ট পণ্যের এলসি খুলতে পারছেন না বলে ব্যবসায়ীরা যে অভিযোগ করে আসছেন তা সঠিক নয়। রমজানের পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাই একসঙ্গে কাজ করলে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কোনো ঘাটতি থাকবে না। গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় এ বছর অনেক বেশি এলসি খোলা হয়েছে।
তিনি সেদিন পণ্য আমদানির কিছু চিত্রও তুলে ধরে জানান, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪১ মেট্রিকটন চিনির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এক বছর আগের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ৪৯৩ মেট্রিকটন। অর্থাৎ এ বছরের জানুয়ারিতে ৫৪ হাজার ৪৪৮ মেট্রিকটন বেশি চিনির ঋণপত্র খোলা হয়েছে।
এই জানুয়ারিতে একইভাবে ভোজ্য তেল আমদানির জন্য ৩ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৩ মেট্রিকটনের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৬০ মেট্রিকটন। এ বছর ২ লাখ ২৪ হাজার ৫৬৭ মেট্রিকটন ছোলা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৬ মেট্রিকটন। অর্থাৎ এ বছরের জানুয়ারিতে ছোলার এলসি কিছুটা কমেছে।
এ বছর ৪২ হাজার ৫৬৩ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময় ছিল যার পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ২২৬ মেট্রিকটন। এ বছর ২৯ হাজার ৪৮২ মেট্রিকটন খেজুরের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আগের বছর যার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৪৯৮ মেট্রিকটন।
কোন পণ্যের চাহিদা কেমন : রোজায় চাহিদা বাড়ে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ ও খেজুরের। এর বাইরে চাল ও আটার চাহিদা সবসময়ই থাকে। চাল বাদে বাকি পণ্যগুলোর চাহিদার বেশিরভাগই মেটানো হয় আমদানি করে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুসারে, রমজানে ভোজ্য তেলের চাহিদা তিন লাখ টন। আর বছরে মোট চাহিদা ২০ লাখ টন। দুই লাখ টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। তবে প্রক্রিয়াকরণের সময় ক্ষতি হওয়ার কারণে ২০ লাখ টনই আমদানি করতে হয়। অন্য সময় মাসিক চাহিদা ১ লাখ ৪০ হাজার থেকে দেড় লাখ টন।
রমজানে দেশে পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ টন। বছরে ২০ লাখ টন। আমদানি হয় বছরে ২০-২২ লাখ টন। পরিশোধনকালে সাড়ে ৬ শতাংশ ক্ষতি হয়। আর স্বাভাবিক সময় দেশে মাসিক চাহিদা দেড় লাখ টন। দেশে রমজানে মসুর ডালের চাহিদা প্রায় এক লাখ টন। বার্ষিক চাহিদা ছয় লাখ টন। বার্ষিক আমদানি হয় চার লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ ২০ হাজার টন।
রমজানে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় চার লাখ টন। বছরে চাহিদা ২৫ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন ২৭ লাখ ৩০ হাজার টন। প্রতি মাসে লাগে দুই লাখ টন। বছরে পেঁয়াজ আমদানি করা হয় ৬-৭ লাখ টন। তবে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রক্রিয়াজাতের সময় ক্ষতি হয় ৮-১০ শতাংশ। এ ছাড়া সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় ক্ষতি হয় ২৫ শতাংশ।
রমজানে ছোলার চাহিদা এক লাখ টন। আর বার্ষিক চাহিদা ১ লাখ ৫০ হাজার টন। আমদানি হয় প্রায় দুই লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৬০০ টন। মাসিক চাহিদা পাঁচ হাজার টন। রমজানে খেজুরের চাহিদা ৫০ হাজার টন। বছরে চাহিদা এক লাখ টন। আর মাসিক চাহিদা পাঁচ হাজার টন।
সুতরাং আমদানির চিত্র ও চাহিদার চিত্রের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে, চাহিদার তুলনায় কোনো পণ্যেরই আমদানি কম হয়নি। বরং কোনো কোনো পণ্যের আমদানি ও মজুদ চাহিদার চেয়েও বেশি হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে সংকট তৈরি না করলে আসন্ন রোজায় ভোগ্যপণ্য ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকার কথা।