পুলিশের একটি প্যারেডে শত শত নারী-পুরুষ পুলিশ সদস্য দাঁড়ানো। এরই মধ্যে তৎকালীন পুলিশ সুপার বর্তমানে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা প্যারেডে থাকা নারীদের দেখছিলেন। সেই দৃশ্য আপত্তিকরভাবে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে টিকটকের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
সেই দৃশ্যটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো। সেই ভিডিও গতকালও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে। নারী-পুরুষ পুলিশ সদস্যদের এমন শত শত টিকটকের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনও ভাইরাল হয়ে আছে। এসব ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর সারা দেশে পুলিশের পোশাক পরে টিকটক ভিডিও তৈরিতে জড়িতদের চিহ্নিত করছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নোংরামি ঠেকানোর দায়িত্ব পুলিশ সদস্যদের। তারা যদি নোংরামি করে তাহলে নোংরামি ঠেকাবে কে?
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটকে নিজেদের সৃজনশীলতা দেখিয়েছিলেন ডিএমপির ১৩ পুলিশ সদস্য। পুলিশের পোশাক পরে এই ভিডিও করে তা প্রকাশ করায় এখন শাস্তির মুখে পড়েছেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এসব ঘটনায় সারা দেশে আরও শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে।
তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী সদস্য বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে। ১৩ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সংবাদে পুলিশের অনেক সদস্য সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তারা অন্য পোশাকে টিকটক করা থেকে বিরত রয়েছেন বলে একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
এসব ভিডিওর ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-৪ শাখা থেকে ২০২০ সালের ৭ মে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নির্দেশিকা-১৯ (পরিমার্জিত সংস্করণ) মেনে চলার জন্য একটি পরিপত্র জারি করা হয়। অভিযুক্তরা সেই নির্দেশিকা অমান্য করে টিকটক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ায় শতাধিক নারী-পুরুষ পুলিশ সদস্য ফেঁসে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার সময়ের আলোকে বলেন, ‘পুলিশের পোশাকে টিকটক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার জন্য অনেকেই ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে থাকেন। তার জন্য একটি আইন করা হয়েছে। ওই আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে, পুলিশের পোশাক পরে কেউ টিকটক, লাইকি বা অন্যান্য আপত্তিকর ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে সেই আওতায় আনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অভিনয় শিল্পী ও পরিচালকদেরও অনুরোধ করেছি যে পুলিশের পোশাক পরে যেন কোনো আপত্তিকর দৃশ্য না করা হয়। কারণ পুলিশের পোশাক পরে টিকটক ও আপত্তিকর ভিডিও পোস্ট করলে তাতে বাহিনীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পুলিশের পোশাক ব্যবহার করে টিকটক, লাইকির মতো মাধ্যমে ভিডিও শেয়ারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদর দফতর।
ডিএমপি সদর দফতর থেকে পাঠানো ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ডিএমপির কতিপয় পুলিশ সদস্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করছেন। এ ধরনের কার্যকলাপ রোধে পোস্টদাতাকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, পুলিশের পোশাক ব্যবহার করে অথবা পুলিশ-বিষয়ক কোনো পোস্ট ফেসবুকে আপলোডের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৯ মেনে চলতে বলা হয়েছে। ডিএমপির এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরও পুলিশের পোশাক ব্যবহার করে অনেকে টিকটক ও লাইকির মতো ভিডিও শেয়ার করেছেন।
পুলিশ সদর দফতর থেকেও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবুও এমন শত শত টিকটক, লাইকি ভিডিও কনটেন্ট ঘুরপাক খাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
গতকালও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কিছু ভিডিও কনটেন্টের দেখা মেলে, যাতে দেখা গেছে পুলিশের অনেক নারী-পুরুষ বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে নাচ-গান, বিভিন্ন দেশের ভাষা ব্যবহার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছবি সংযুক্ত করে জনপ্রিয় কোনো গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাচ্ছেন (লিপসিং)। এ ছাড়াও হিন্দি বা বাংলা ছবির কোনো বিখ্যাত সংলাপ আওড়ানো, নাচ-গান, মজা করার ভিডিও দেখা গেছে। এসব ভিডিও পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখে পড়ায় তারাও বিব্রত হন। অনেক ভিডিওতে নারী ও পুলিশ কনস্টেবলকে একই সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচ-গান, এমনকি আপত্তিকর অবস্থায়ও দেখানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মনসুর রহমান গতকাল রাতে সময়ের আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ভিডিওর ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দফতরে নির্দেশনা রয়েছে, যারা এসব করছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমনকি বিভিন্ন ইউনিট তাদের মতো করে ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে সংখ্যাটা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন আরও শতাধিক পুলিশ সদস্য নজরদারিতে রয়েছে। আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’