প্রকাশ: সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:৫৭ পিএম (ভিজিট : ৩৩৫)
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিশ্বে র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বে সামরিক ও অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার আমেরিকার একক আধিপত্যের বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলা শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাসীর দীর্ঘদিনের ঘুম ভেঙে গেছে। হামলা শুরুর পর বিশ্বে র অনেক দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক পক্ষ রাশিয়ার দিকে, অন্য পক্ষ ইউক্রেনের পক্ষে। বিশ্ববাসীর যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বুঝতে একটু দেরি হয়েছে। কেননা শুরুর দিকে ইউক্রেনকে প্রকাশ্যেই অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দেয়। ইউক্রেন সেই মতো প্রতিহত ও পাল্টা-আক্রমণ শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। যা-ও দিচ্ছে তা-ও অনেক পুরনো এবং অকার্যকর বলে অভিযোগ তুলেছে ইউক্রেনের সেনারা। পশ্চিমারাও সেই তালে তাল দিয়ে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে মিলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিজেরাই এখন মহাবিপদে। অস্ত্র দিতে গিয়ে একদিকে তারাই অস্ত্রের সঙ্কটে পড়েছে। অন্যদিকে রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় রাশিয়া তেল, গ্যাস সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ইউরোপের দেশগুলো। শুধু তা-ই নয়, পুতিন সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় রাশিয়া নতুন নীতি ঘোষণা করেছে যে, কোনো দেশ রাশিয়া থেকে কিছু কিনতে হলে তাকে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে দাম পরিশোধ করতে হবে। এতে করে বিশ্বব্যাপী রুবলের মূল্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
রাশিয়া থেকে তুলনামূলক কম দামে জ্বালানি তেল কিনে একদিকে চীন অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়াও তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। ইউরোপেরও অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের হাতের তাস ন্যাটোতেও ফাটল ধরেছে। সদস্যভুক্ত অনেক দেশে সাধারণ জনগণ ন্যাটোবিরোধী আন্দোলনে নেমেছে। বিশেষ করে অস্ট্রিয়া। দেশটির প্রশাসন ন্যাটোর সদস্য না হলেও ন্যাটোর সঙ্গে মিলে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়। এদিকে ন্যাটোর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও এশিয়ার একমাত্র সদস্য দেশ তুরস্কও বেঁকে বসেছে। কারণ সম্প্রতি রাশিয়ার কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং তার শত্রু দেশ গ্রিসকে উসকে দেয় তুরস্কের বিরুদ্ধে। দেশে দেশে গোয়েন্দা লাগিয়ে পছন্দমতো সরকার ক্ষমতায় নিয়ে আসা, যুদ্ধ বাধিয়ে সেখানে অস্ত্রের ব্যবসা এবং মোড়ল সেজে দাদাগিরি করার যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের খেলা বিশ্ব এবার বুঝে গেছে।
গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের নাম দিয়ে গোটা বিশ্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একক আধিপত্য বজায় রাখা, দাঙ্গা লাগিয়ে লাখ লাখ বেসামরিক লোককে হত্যা করার এই নোংরা রাজনীতি এখন প্রকাশ হয়ে গেছে। আফগানিস্তানে ২০ বছরের মিশনে পরাজিত হওয়ায় তার অবস্থান কিছুটা হলেও নাজুক হয়ে পড়েছে। পুতিন সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতশত্রু ইরান সফর করে এবং তাদের তৈরি ড্রোন রাশিয়ায় সরবরাহ করার বিনিময়ে রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক স্টেলথ যুদ্ধবিমান দেওয়ার চুক্তিটি নিশ্চিত করেছে। ইতোমধ্যে ইরানের ড্রোন রাশিয়ায় পৌঁছে গেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে তা সফলভাবে ব্যবহারও করছে রাশিয়া। এতে করে রাশিয়ার মিলিয়ন ডলারের মিসাইলের বদলে অল্প খরচে হামলা চালাতে পারছে, অন্যদিকে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান হাতে পেয়ে আকাশেও ইরান ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। এ জন্য সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইল। পারস্য উপসাগরে ইরানের শক্তিশালী নৌবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন এবং জাহাজ আটকের ঘটনাও ঘটিয়েছে। সম্প্রতি ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেছেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম। ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরি থেকে ঠেকানোর জন্য অনেক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত বিশ্বে র সর্বাধিক নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশ ছিল ইরান। কিন্তু ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সব চেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণ করে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে। কিছু কিছু বিশ্লেষক তো বলেই দিয়েছেন যে, ইরান গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে। এতে করে ইরান যে আমেরিকাকে আর ভয় করে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র ফ্রান্সও তাদের ওপর চটেছে। কারণ ২০১৬ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ১২টি ইঞ্জিনচালিত সাবমেরিন তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং সেই সহযোগিতার চুক্তি বেশ কিছু দূর এগিয়েছিল। ফ্রান্স এই সাবমেরিনগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকে দেবে বলে নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন এক চুক্তির কারণে অস্ট্রেলিয়া ৯০ বিলিয়ন ডলারের এই ক্রয়াদেশ বাতিল ঘোষণা করেছে। এ ঘটনায় ফ্রান্স চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তার মতে, এটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ফ্রান্সের এক মন্ত্রী বলেছেন, এটা শুধু চুক্তি ভঙ্গ নয়, এটা তাদের পিঠে ছুরিকাঘাতের শামিল। ন্যাটোতে থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ফ্রান্স। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বে র মুসলিম দেশগুলোও তাদের দীর্ঘদিনের শত্রুতা ভুলে এক হচ্ছে। নতুন বাণিজ্য চুক্তি করে আমেরিকার বলয় থেকে বেরিয়ে আসছে। জাতিসংঘকে এতদিন বাইডেন প্রশাসন নিজেদের প্রয়োজনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এলেও সেই বুদ্ধিকেও নস্যাৎ করে দিয়ে চীন এবং রাশিয়া জাতিসংঘে তাদের আধিপত্য খাটাতে শুরু করেছে। তা ছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানে চীনের প্রযুক্তি পাওয়া গেছে এমন অভিযোগে বিমানটির সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে করে যারা এ পর্যন্ত বিমানটি কিনেছে তারাও আশঙ্কা করছে যে এটার গোপন প্রযুক্তি চীনের হাতে চলে গেছে। কিন্তু প্রযুক্তি ফাঁস না হওয়া নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্ররাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দেশটির বিশিষ্টজনরাও বলছেন, বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী আচরণকে দায়ী করছেন এবং দেশটিকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে পারমাণবিক বোমা হামলা করার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট কিছু গণমাধ্যম নিয়মিত প্রচার করে আসছে যে সেখানে কোনো পারমাণবিক রেডিয়েশন নেই। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলছে। আজও সেখানে মানুষ জন্মালে বিকলাঙ্গ হয়।
দেশটির প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি নিজ দেশের সমালোচনা করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে র প্রধান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ও বিশ্বশান্তির জন্য বৃহত্তম হুমকি। কেননা যুদ্ধ লাগিয়ে অস্ত্র ব্যবসা করে, নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক যে প্রভাবটা ছিল সেটাও কমে যাচ্ছে। এখন আর কোনো দেশ তাদের কথা শুনে যুদ্ধে জড়াচ্ছে না।
ফলে অস্ত্র ব্যবসাও হচ্ছে না আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে আসছে। এ জন্য এশিয়ায় যুদ্ধ লাগানোর কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীনকে ক্ষেপিয়ে তোলার সব রকম চেষ্টাই করছে। কিন্তু চীনও কৌশলে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক দিকে দুর্বল হয়ে পড়া দেশগুলোর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এশিয়ার বাইরেও চীন বেশ প্রভাব রাখতে শুরু করেছে। পাশাপাশি নিজস্ব প্রযুক্তিতে সব রকম সমরাস্ত্র তৈরি এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়াসহ সব দিক থেকে চীন এক নতুন পরাশক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তাদের ৪০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি নিয়েও চারদিক থেকে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দিয়ে কৌশলে বিশ্বব্যাপী নিজের যে প্রভাব বা আধিপত্য এতদিন কায়েম করে রেখেছিল তা ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থী, বরেন্দ্র কলেজ রাজশাহী