ই-পেপার শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিসর্গটা যেন কোথায় বসবে?
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১:১৯ পিএম আপডেট: ১৬.০৯.২০২২ ১:২৪ পিএম  (ভিজিট : ১৮০৮)
‘অধস্তন। অর্থ : ‘নিম্নপদস্থ’। শব্দটিকে বিশ্লিষ্ট করলে এই চেহারা দাঁড়াবে : অধঃ+তন। সন্ধির নিয়মে বিসর্গ উঠে গিয়ে এক্ষেত্রে ‘স’ হচ্ছে এবং সেই ‘স’ গিয়ে বসছে পরবর্তী বর্ণ ‘ত’-এর মাথায়। কাগজে মাঝে মাঝে ‘অধঃস্তন’ বানান বের হয়। এই ভুল বানানে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘নিম্নস্থ স্তন’। বিচ্ছিরি ভুল।’ [বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড]

কথায় আছে, যে জানে না ব্যাকরণ, তার বিদ্যা অকারণ। ব্যাকরণ না জানার কারণে বিদ্যা একেবারেই অকারণ না হলেও ভাষাকে সুশৃঙ্খল ও সুসংহত করার জন্য ব্যাকরণচর্চা অপরিহার্র্য। বিশেষ করে যারা সংবাদপত্রে সম্পাদনাকর্মে যুক্ত তাদের সঙ্গে ব্যাকরণের সম্পর্ক জীবনধারণের নিমিত্ত অন্নের মতোই-একবেলা না খেলে আরেকবেলা খেতেই হয়।

বাংলা ভাষার ব্যাকরণে একটা অনিবার্য আসন করে নিয়েছে ‘বিসর্গ’ (ঃ) বর্ণটি। বর্তমানের বাংলা বর্ণের ক্রমানুসারে ‘বিসর্গ’ ৪৯তম বর্ণ। আর ব্যঞ্জনবর্ণ হিসেবে এর অবস্থান ৩৮তম। বাস্তবতা হলো-আমরা প্রায়ই দোটানায় পড়ি বাংলা শব্দে বিসর্গের স্থান নির্ধারণ নিয়ে। সংবাদপত্রের সম্পাদনা সহকারী থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় সম্পাদক পর্যন্ত এ সমস্যার শিকার হন।

বাংলা ভাষায় বিসর্গ বর্জন-গ্রহণের বিতর্কটা মূলত সংস্কৃত বা তৎসম ভাষাকেন্দ্রিক। বাংলা ভাষায় বিসর্গের ব্যবহার নিয়ে মতপার্থক্য আছে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যেও। যেসব সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ থেকে কালক্রমে বাংলা ভাষায় পাকাপাকি আসন করে নিয়েছে সেসব শব্দের শেষে বিসর্গ বর্জনের পক্ষেই মত দিয়েছেন বেশির ভাগ ব্যাকরণবিদ। তাদের মতে, ‘বাংলা ভাষা যেহেতু সংস্কৃত নয়, তাই বাংলা শব্দে নির্বিচারে বিসর্গ দেওয়া অনাবশ্যক।’ এর একটি অন্যতম কারণ একই শব্দের উচ্চারণ সংস্কৃতে এক রকম, আর বাংলায় আরেক রকম। তাই উচারণ যেহেতু পার্থক্য, সেহেতু সেই শব্দের বানানেও পার্থক্য থাকা সমীচীন। বলাবাহুল্য, এই মতের অন্যতম প্রবক্তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ব্যাকরণ নিজের পায়ে দাঁড়াক-এটা ছিল তাঁর ঐকান্তিক চাওয়া।

প্রসঙ্গত, যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিত আকারে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে তাদের তৎসম শব্দ বলে [তৎসম = তৎ = সংস্কৃত, সম = সমান; অর্থাৎ
সংস্কৃতের সমান]। বাংলা ভাষায় প্রায় ৫৫ হাজার তৎসম শব্দ রয়েছে বলে জানা যায়। 

শব্দের শেষে প্রয়োজন নেই বিসর্গের
প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে শব্দের শেষে বিসর্গ লেখা হয় না। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার সমিতি বিধান দিয়েছিল-‘বাংলা বিসর্গান্ত শব্দের শেষের বিসর্গ বর্জিত হইবে, যথা-আয়ু, মন, ইতস্তত, ক্রমশ, বিশেষত ইত্যাদি।’ বর্তমানে বাংলা ভাষায় পূর্ণ শব্দের শেষে বিসর্গ বর্জনের যে রীতি প্রচলিত সেটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিধান অনুসরণেরই ফল। 

এখানেও একই যুক্তি- উল্লিখিত শব্দগুলো সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ থেকে আসা। উচ্চারণের বিষয়টিও বিবেচ্য। সংস্কৃত ভাষায় শব্দের শেষে বিসর্গ উচ্চারিত হলেও বাংলা ভাষায় এর যথাযথ উচ্চারণ নেই। তাই আপাততঃ, ইতস্ততঃ, করতঃ, কার্যতঃ, ক্রমশঃ, ধর্মতঃ, ন্যায়তঃ, প্রধানতঃ, প্রায়শঃ, বস্তুতঃ, বিশেষতঃ, মূলতঃ, সাধারণতঃ ইত্যাদি শব্দের বানান বাংলায় আপাতত, ইতস্তত, করত, কার্যত, ক্রমশ, ধর্মত, ন্যায়ত, প্রধানত, প্রায়শ, বস্তুত, বিশেষত, মূলত, সাধারণত লিখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলা ভাষার প্রধানতম ধ্বনিবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুহম্মদ আবদুল হাই [১৯১৯-৬৯] তার ‘বাঙলা লিপি ও বানান সমস্যা’ প্রবন্ধে শব্দের শেষে বিসর্গের ব্যবহার প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘এর যথাযথ উচ্চারণ বাঙলায় নেই। ক্রমশঃ, আপাততঃ, প্রধানতঃ, সাধারণতঃ প্রভৃতি শব্দে এ-কালে বিসর্গ উচ্চারিত হয় না তা-ই নয়, বানানেও দেখানো হয় না।’ 

এ ছাড়া অব্যয় জাতীয় শব্দের শেষে থাকলে বাংলায় বিসর্গ বর্ণের ধ্বনি ‘হ’-এর মতো শোনায়। যেমন : যাঃ!, আঃ!, ওঃ!, উঃ!, ইঃ! প্রভৃতি। তাই এ ধরনের অব্যয়ের শেষেও বিসর্গ বর্জন বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রেও মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য-তিনি বলেন, ‘আঃ!, ওঃ!, উঃ!, ইঃ! প্রভৃতি অব্যয়ে বিসর্গ লেখা হয় বটে, কিন্তু তা আশ্রয়স্থানভাগী অঘোষ শিস ধ্বনিই; ঃ [বিসর্গ] নামক অতিরিক্ত চিহ্ন ব্যবহার না করে মহাপ্রাণ অঘোষ হ্ দিয়ে তার প্রতিবর্ণীকরণ করা যেতে পারে।’ বর্তমানে মহাপ্রাণ অঘোষ হ্ দিয়ে বিসর্গের প্রতিবর্ণীকরণের রেওয়াজই প্রচলিত। যেমন : আহ্!, উহ্!, ওহ্!, ইহ!, ইত্যাদি।

শব্দের মাঝখানে বিসর্গের ব্যবহার ও বর্জন : যুক্তি-উদাহরণ
বিসর্গ ব্যবহারের সঙ্গে সন্ধি ও সমাসবদ্ধ শব্দের সম্পর্ক নিবিড়। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত কোনো শব্দের মাঝখানে বিসর্গ (ঃ) থাকলে তার পরবর্তী ব্যঞ্জনের ধ্বনি দ্বিত হয়। যেমন : দুঃখ > দুক্খো, অতঃপর > অতোর্প্প, অধঃপাত > অধোপ্পাত, অন্তঃকরণ > অন্তোক্করোন্, অন্তঃপুর > অন্তোর্প্পু, অন্তঃসার > অন্তোর্শ্শা প্রভৃতি। এ ছাড়া সমাসবদ্ধ পদে ‘শ’ ‘ষ’ ‘স’ পরে থাকলে বিসর্গ স্বরূপে স্বস্থানে অবস্থান করে। যেমন : নিঃশব্দ, বয়ঃসন্ধি, অন্তঃশীলা, দুঃসাহস। এক্ষেত্রেও বিসর্গ-পরবর্তী ব্যঞ্জনের ধ্বনি দ্বিত হয়। যেমন : নিঃশব্দ > নিশ্শব্দো।

মুহম্মদ আবদুল হাই এসব ক্ষেত্রে বিসর্গ না রেখে তাদের ধ্বনি অনুগামী বানান দুক্খ, অধোপ্পাত, মনোপূত কিংবা মনপ্পূত লেখাই শ্রেয় মনে করলেও এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। ভিন্নমতের পক্ষে যুক্তি হলো-বিসর্গ একটি বাংলা বর্ণ; এটি কোনো চিহ্ন নয়। বিসর্গকে বর্ণ হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে যেসব শব্দে বিসর্গ-পরবর্তী ব্যঞ্জনের ধ্বনি দ্বিত হয় সেসব শব্দের মাঝখানে বিসর্গ ব্যবহারের মতোই প্রবল। রবীন্দ্রনাথও এ মতের বিরোধিতা করেননি। সুতরাং অধোপ্পাত নয়, অধঃপাত লেখাই সমীচীন। তবে অধোবাস (অধঃ+বাস) হবে, অধোব্বাস নয়। কারণ এখানে বিসর্গের পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত হয়নি।

আবার কখনো সন্ধির নিয়মে বিসর্গ উঠে গিয়ে ‘স’ হয় এবং সেই স পরবর্তী ‘ত’-এর মাথায় যুক্ত হয়। যেমন : অধঃতন > অধঃ+তন। এখানে বিসর্গ লোপ পেয়ে শব্দটি হয়েছে ‘অধস্তন’। বিসর্গের পর স্ত, স্ব বা স্বঃ থাকলে বিকল্পে বিসর্গের লোপ হয়। অন্তঃস্থ > অন্তস্থ, বা মনঃস্থ > মনস্থ, দুঃস্থ > দুস্থ, নিঃস্তব্ধ > নিস্তব্ধ, নিঃস্পৃহ > নিস্পৃহ। এখানেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য- তাঁর মতে, কোনো শব্দে ‘স’ যখন কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের পূর্বে যুক্ত হয়ে থাকে তখন তার পূর্বে বিসর্গ লিখলেও চলে, না লিখলেও চলে।

এ ছাড়া বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ কিংবা য, র, ল, ব, হ পরে থাকলে অ-কারের পরস্থিত বিসর্গ পূর্বস্থিত অ-কারের সঙ্গে মিলিত হয়ে ও-কারে পরিণত হয়। অধঃ+মুখ > অধোমুখ, সদ্যঃ+জাত সদ্যোজাত, সরঃ=বর > সরোবর, মনঃ+জ > মনোজ ইত্যাদি। স্বরবর্ণ, বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ কিংবা য, র, ল, ব, হ পরে থাকলে অ-কারের পরস্থিত র-জাত বিসর্গ নিজ মূলরূপ অর্থাৎ র-ভাব ফিরে পায় এবং এই র-কার পরবর্তী স্বরের সঙ্গে কিংবা ‘রেফ’ রূপে পরবর্তী ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন : পুনঃ+বার > পুনর্বার, পুনঃ+যাত্রা > পুনর্যাত্রা ইত্যাদি। ‘র’ পরে থাকলে পূর্ববর্তী বিসর্গ স্থানে যে র্‘’ হয় তা লোপ পায় এবং পূর্বস্বর দীর্ঘ হয়। যেমন : নিঃ+রো > নীরোগ, নিঃ+রস > নীরস, নিঃ+রব > নীরব ইত্যাদি। 

  বাংলায় সাধারণত অঙ্কের সংখ্যা ছাড়া বিন্দু চিহ্ন (.) বা সিঙ্গেল ডটের ব্যবহার দেখা যায় না। কিন্তু বিদেশি বিভিন্ন শব্দ-সংক্ষেপণের জন্য এই চিহ্নের ব্যাপক ব্যবহার চোখে পড়ে। কোনো পূর্ণ শব্দকে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশ করার জন্য ওই শব্দের অগ্রভাগের শব্দ বা শব্দাংশের শেষে বিসর্গ ব্যবহার করা হয়। যেমন : মোহাম্মদ সংক্ষিপ্ত করে লেখা হয় > মোঃ। একইভাবে মোসাম্মত > মোসাঃ, ডাক্তার > ডাঃ, ডক্টর > ডঃ, মিস্টার > মিঃ ইত্যাদি। তবে বর্তমানে এ ধরনের সংক্ষিপ্ত শব্দের বানানে ডট বা বিন্দু ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন : মোহাম্মদ > মো., মোসাম্মত > মোসা., ডাক্তার > ডা., ডক্টর > ড., আবদুল > আ. ইত্যাদি। বস্তুত শব্দ-সংক্ষেপণের কাজে বিসর্গের তুলনায় বিন্দু চিহ্নের ব্যবহারই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।

বিসর্গের স্থলে কোলন : কেবলই ভুল
অভ্যাস বা ভুলবশত অনেকেই বিসর্গের স্থলে কোলন এবং কোলনের স্থলে বিসর্গ ব্যবহার করেন। যেমন : আন্তঃজাতিক না লিখে লেখেন আন্ত:জাতিক, বহিঃবিশ্বের স্থলে লেখেন বহি:বিশ্ব, প্রাতঃরাশ না লিখে লেখেন প্রাত:রাশ। বিসর্গের স্থলে কোলনের ব্যবহার পুরোপুরি ভুল। এমন ভুল পরিত্যাজ্য। যদিও এখন আর সংবাদপত্র ও সাহিত্যে বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আন্তঃজাতিক ও বহিঃবিশ্ব লেখা হয় না, লেখা হয় আন্তর্জাতিক ও বহির্বিশ্ব। 

এ জাতীয় অন্যান্য শব্দের ক্ষেত্রেও একই চর্চা অব্যাহত। বিসর্গ গ্রহণ ও বর্জন নিয়ে এ রকম উদাহরণের তালিকা হয়তো আরও দীর্ঘ করা যেতে পারে। কিন্তু আপাতত সেটা ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনেই তোলা থাক। সব শেষে বলতে চাই, বিচ্ছেদ নয়, ব্যাকরণের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধনেই সমৃদ্ধ হোক বাংলা ভাষা। আর সেই সঙ্গে বিসর্গও সযত্নে ব্যবহৃত হোক আমাদের দৈনন্দিন ভাষা চর্চায়।

[লেখাটি তৈরিতে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা; বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, মাটিগন্ধা, ঢাকা; বাংলা : কী লিখবেন, কেন লিখবেন, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা; প্রমিত বাংলা লেখার নিয়মকানুন, ড. হায়াৎ মামুদ ও ড. মোহাম্মদ আমীন, পুঁথিনিলয়, ঢাকা; আমার বই, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে]

/জেডও




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close